রাজা-রানি আর মোগল প্রেক্ষাপট বিলীন হলেও আছে বাদুড়ের রাজত্ব

    আজিজুল কদির :

    চট্টগ্রাম নগরীর রাজাপুকুর লেইনে রাজা নেই। কাপাসগোলায় কার্পাস নেই। পাঠানটুলিতে পাঠান নেই। মোগলটুলিতে মোগল, জামতলায় জামগাছ, ঝাউতলায় ঝাউগাছ নেই। তেমনি নগরের বাদুরতলায়ও নেই বাদুড়। হাজার বছরের চট্টগ্রাম শহরে রাজা-রানি আর মোগল প্রেক্ষাপট বিলীন হলেও স্থানমাহাত্ম্যে বাদুড়ের অস্তিত্ব কিন্তু রয়ে গেছে।

    জনশ্রুতি রয়েছে, একসময় চট্টগ্রাম শহরের বাদুরতলায় একটি বড় বৃক্ষে অসংখ্য বাদুড়ের বসবাস ছিল। আর সেই থেকে এলাকাটির নাম হয়েছে বাদুরতলা। কখন থেকে বাদুরতলায় বাদুড় নেই, এটির সঠিক দিনক্ষণ কারোরই জানা নেই। তবে শহরের বাদশা মিয়া সড়কে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণের গাছ-গাছালিতে শত শত বাদুড়ের আবাসস্থল এখনো দেখা যায়।

    শহুরে লোকালয়ে বাদুড়ের বসবাস আর গোধূলিলগ্নে ওদের কিচিরমিচির শব্দে পথচারী ও আশপাশের মানুষজন মুহূর্তের জন্য হলেও চারুকলা ইনস্টিটিউটের গাছ-গাছালির দিকে গলা উঁচিয়ে তাকায়। বাদুড় দিনের বেলায় উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। এদের দৃষ্টিশক্তি কম। তাই চলাচলের সময় মুখ দিয়ে ক্রমাগত শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি করে আশপাশের সম্ভাব্য বাধাবিঘ্ন সম্পর্কে ধারণা নিয়ে এগিয়ে চলে।

    বাদুরতলার পাশের বাসিন্দা কবি ও সাংবাদিক হাফিজ রশিদ খান বলেন, ছোটবেলায় বাদুরতলায় বাদুড়ের ঝাঁক আমার চোখেও পড়েছে। জঙ্গি শাহ মাজারে ঢোকার ডানপাশজুড়ে ছিল সুবিশাল এক বটগাছ। ওখানে সন্ধ্যার পর ঝাঁকঝাঁক বাদুড় ঝুলে থাকতো। মুক্তযুদ্ধের পরেও ওই এলাকা ছিল আলো-আঁধারি আর স্যাঁতসেঁতে ধরনের। তখনও বাদুড়ের বিচরণ ছিল ওই বটগাছ ঘিরে।

    চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক প্রণবমিত্র চৌধুরী বলেন, আগে হরহামেশা নিশাচর প্রাণী বাদুড়ের দেখা মিললেও এখন দুষ্পাপ্য হয়ে উঠেছে নিরীহ প্রাণীটি। তবে অবাক করার মতো বিষয় হলো, কোলাহলমুখর চট্টগ্রাম নগরীর চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলে পরম নিশ্চিন্তে বাস করছে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড়। এদের নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদেরও। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, সময়টা যখনই হোক না কেন, গাছে থাকেই ঝুলন্ত বাদুড়ের ঝাঁক।

    প্রায় দুযুগেরও বেশি সময় ধরে এখানেই বসবাস ওদের। গোটা দিন ঘুমিয়ে কাটায়, আর সন্ধ্যায় বের হয় খাবারের খোঁজে। রাতের আঁধারেই আবার ফিরে আসে আবাসস্থলে। এসব বাদুড়ের ঝাঁককে সঙ্গী করে এই আঙিনায় চলে চারুকলার শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, ছবি আঁকাসহ প্রকৃতির নানা পাঠ।

    চারুকলায় বাদুড়ের এই আবাসস্থল নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রমেন্টাল সায়েন্সের প্রফেসর ড. এস এম শামসুল হুদা জানান, বাদুড় সবসময় আবাসস্থল হিসেবে উচুঁ গাছ বেছে নেয়। আর স্যাঁতসেঁতে ও ঠান্ডা, কোলাহলমুক্ত পরিবেশই ওদের পছন্দ। সেই সাথে আশপাশে তাদের খাদ্য নিশ্চিত হওয়ার পর তবেই আবাসস্থল ঠিক করে নেয়। চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণ তাদের অনুকূলে বলেই তারা এখানে ডেরা গেড়েছে।

    ফলখেকো বাদুড়ের জন্য অনেকেই বিরক্ত হয়। কিন্তু বাদুড় অনেক পোকামাকড় খেয়ে ফসল ও পরিবেশরক্ষায় ভূমিকা রাখে। বাদুড় নিশাচর। এরা দিনের বেলায় দেখতে পায় না। উড়ে উড়ে রাতকে সজাগ রাখে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের এই প্রাঙ্গণকে বাদুড়ের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।

    চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া জানান, বাদুড় স্তন্যপায়ী। প্রায় ৭০ ভাগ বাদুড় পতঙ্গভুক, বাকিরা ফলমূল খায়। পৃথিবীজুড়ে এ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ১০০ প্রজাতির বাদুড়ের সন্ধান মিলেছে। বাংলাদেশের ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ীর মধ্যে এক-চতুর্থাংশই বাদুড়। বাংলাদেশে মাত্র হাতেগোনা যে কয়েকটি প্রজাতির বাদুড়ের দেখা মেলে তার মধ্যে কলাবাদুড়ের সংখ্যাই বেশি।

    ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইনসেক্ট ব্যাট’। এরা ডুমুর, বট, আম, ছাতিম, রেইনট্রি, গণশিরীষ, নারিকেল, তাল, সুপারি, খেজুর গাছ ও বাঁশঝাড়ে এক ডজন থেকে এক হাজার সংখ্যার একটি দলে থাকে।
    ব্যাট কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনালের মতে, ১৫০টি বাদুড় বছরে ফসলের জন্য ক্ষতিকর যে সংখ্যক পোকা খায়, তা কৃষককে অন্তত একশ কোটি ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।

    একটি মাঝারি আকারের বাদুড় ঘণ্টায় যে সংখ্যক পোকা খায়, তা একজন মানুষের একরাতে ২০টি পিজ্জা খাওয়ার সমান। বাদুড়ের সবচেয়ে বড় কলোনি বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ব্র্যাকেন গুহাকে। ধারণা করা হয়, ওই এক গুহাতেই প্রায় দুই কোটি বাদুড় রয়েছে।

    বিএম/রাজীব সেন..