বাংলাদেশ মেইল || নিজস্ব প্রতিবেদক :
পরপর দুইবার ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। লেবারের হয়ে লন্ডনের কিলবার্ন -হ্যামস্টেট আসন থেকে তৃতীয়বারের মতো প্রার্থী হয়েছেন। তার সামনে এখন হ্যাটট্রিক জয়ের চ্যালেঞ্জ। ১২ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের প্রাধান্যের কেন্দ্রে রয়েছে ব্রেক্সিট ইস্যু। কোনও দল কিংবা প্রার্থীর চেয়ে ব্রেক্সিট প্রশ্নে ভোটারদের অবস্থানই ফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রার্থী হিসেবে টিউলিপ বলা চলে পরিপক্ষ। কারন ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিলের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হবার পর থেকে হারার রেকর্ড নেই টিউলিপের। নির্বাচনের পাশাপাশি এনএসসিতে দলের কোরামেও পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন এবারের নির্বাচনে হ্যাম্পস্টেট-কিলবার্নে পূর্ব ইউরোপীয় ও মুসলিম ভোটারদের সমর্থন টিউলিপের জয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে দলের প্রধান জেরেমি করবিনের ইহুদি বিদ্বেষ এ আসনটিতে লেবার সম্পর্কে ঋনাত্নক মনোভাবের জন্ম দিতে পারে।
ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনের আর ১৪ দিন বাকী। নির্বাচনে যে পাঁচ-ছয়টি আসনের জয়-পরাজয় নিয়ে ভোটার ও ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের উন্মুখ দৃষ্টি; তার একটি হলো টিউলিপের হ্যামপস্টেড ও কিলবার্ন। লন্ডনের আসনগুলোর মধ্যে এবারও সেখানেই সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোটের লড়াই হবে। নব্বইয়ের দশক থেকে এ আসনটি ব্রিটেনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে। এ আসনটি বৃটেনের পার্লামেন্ট ভবনের পাশ্ববর্তি। ২০১০ সালের আগে টানা ২৩ বছর এ আসনটিতে লেবার পাস করেছে। ১৯৯২ সাল থেকে অস্কারজয়ী বরেণ্য অভিনেত্রী গ্ল্যান্ডা জ্যাকসন দীর্ঘ ২৩ বছর হ্যামপস্টেড ও কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্ন্ত ২০১০ সালের নির্বাচনে তিনি মাত্র ৪২ ভোটে জয় পান। পরে এই আসনে প্রার্থী হন টিউলিপ সিদ্দিক (২০১৫) । মুলত টিউলিপ ইয়াং লেবারের বিএমই অফিসার হিসেবে শুরু থেকেই নিজের দক্ষতার প্রমান রেখেছিলেন। যার কারনে ২০১৩ সালে হ্যামস্টেট ও কিলবার্ন এলাকা থেকে লেবারের প্রার্থী হিসেবে শর্ট লিস্টেট হন তিনি। এরপর লেবার চেয়ার এড মিলিব্যান্ড’র সাথে সখ্যতা আর নিজের দক্ষতায় এনএসসি’তে পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
এ আসনটি বাঙালী অধ্যুষিত না হওয়ার কারনে বৃটিশ বাংলাদেশী প্রার্থী হিসেবে বাড়তি সুবিধা পাননি টিউলিপ। বরং লেবার প্রার্থী হিসেবে শর্ট লিস্টেট হওয়া তার জন্য কস্টকরই ছিল।
ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. শফিক সিদ্দিক ও শেখ রেহানা দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে টিউলিপ দ্বিতীয়। তার মা বাবার বিয়েও হয়েছিল এই কিলবার্নেই। ২০১৫ সালে এ আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচিত হন টিউলিপ। ওই নির্বাচনে ২৩,৯৭৭ ভোট পান তিনি। ২০১৭ সালের নির্বাচনে তিনি ৩৪,৪৬৪ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন।
লন্ডনে জন্ম নেওয়া টিউলিপ ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হয়ে যুক্ত হন ব্রিটিশ রাজনীতিতে। আইনপ্রণেতা হওয়ার আগে তিনি ক্যামডেনের কাউন্সিলর ছিলেন। সক্রিয় ছিলেন ইয়াং লেবারে। ইউনিটের মিডিয়া অফিসারের দায়িত্ব পালনও করেছিলেন।
দুই দফায় আইনপ্রণেতা হওয়ার পর ব্রিটেনের নানা রাজনৈতিক ইস্যুতে পার্লামেন্টের ভেতরে-বাইরে রীতিমত ঝড় তুলতে সক্ষম হন টিউলিপ। সাড়ে চার বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করেই তিনি ব্রিটেনের রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন।
পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীণ -বো আসন কিংবা পপলার কেনিং টাউন আসনে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের আধিপত্য রয়েছে, হ্যামপস্টেড ও কিলবার্নে তা নেই। ফলে সেন্ট্রাল লন্ডনের কাছের এ আসনে জয়-পরাজয়ের অন্যতম নিয়ামক স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের ভোট। অনেক আগ থেকেই লেবারের বর্তমান প্রধান জেরিমি করবিন ইহুদি বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত বৃটেনের রাজনীতিতে। সম্প্রতি এ বিষয়ে নিজের দৃস্টিভঙ্গির কারনে ইহুদিদের কাছে তিনি ক্ষমা চাইতেও রাজি নন জেরেমি -এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে। ফলে কিলবার্নে দলের চেয়ে নিজের ইমেজের উপর ভরসা করতে হচ্ছে টিউলিপকে। ছোট বেলা থেকে কিলবানে বসবাস করার কারনে স্থানীয়দের সাথে তার সখ্যতাও ভালো। তাদেরকে কাছে টানার চেষ্টায় রয়েছেন টিউলিপ। গত নির্বাচনে কনজারভেটিভ প্রার্থী ক্লারে লিউস এই আসন থেকে ১৮,৯০৪ ভোট পান, যা মোট ভোটের ৩২.৪ শতাংশ। আর টিউলিপ পান মোট ভোটের ৫৯ শতাংশ। এই আসনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের নতুন প্রার্থী জনি লুক। তবে এবার সেখানে লেবার পার্টির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লিবারেল ডেমোক্রেট (লিবডেম)।
নির্বাচনী জরিপে লিবডেম প্রার্থী ম্যাথ স্যান্ডারর্স খানিকটা এগিয়ে রয়েছে। তবে তিন প্রার্থীর মধ্যে টিউলিপের ব্যাক্তগত পরিচিত বেশি । মা শেখ রেহেনা ও খালা শেখ হাসিনার অনুগত বিশাল কর্মিবাহিনী টিউলিপকে অন্যান্য প্রার্থীর কাছ থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে উন্নীত করেছে। তাছাড়া লেবার পার্টির বর্তমান সাংসদ হিসেবে ব্যক্তি ইমেজের দিক থেকেও তিনি এগিয়ে রয়েছেন। লেবার পার্টির কর্মী বাহিনীর পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত অনুরাগী-সমর্থকরাও লিফলেট আর হ্যান্ডবিল নিয়ে ছুটছেন ঘরে ঘরে।
ধারণা করা হচ্ছে, দুইবার আইনপ্রণেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় নিজ আসনের জনগণের প্রতি টিউলিপের সংবেদনশীল ও বিনয়ী আচরণ তাকে এবারের নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা দেবে।
ভোটার ও সাধারণ মানুষের কাছে টিউলিপের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও এবারের নির্বাচনে তা কতোটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে অবশ্য খানিকটা সংশয় রয়েছে। প্রভাবশালী জরিপ সংস্থা ইউগভ-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আগামী ১২ই ডিসেম্বরের আগাম নির্বাচনের ফলাফলের কোনও নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে না৷ সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ৮৬ শতাংশ ব্রিটিশ ভোটার এই মুহূর্তে মূলত ব্রেক্সিটের পক্ষে অথবা বিপক্ষে অবস্থান নিতে ব্যস্ত৷ কোনও নির্দিষ্ট দলের প্রতি আনুগত্য সে ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে না৷
ক্ষমতায় ফিরলে কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানুয়ারি মাসের শেষে ব্রেক্সিট কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন৷ অন্যদিকে লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিন ক্ষমতায় এলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দর কষাকষি করে ব্রেক্সিট চুক্তিতে রদবদল করে দ্বিতীয় গণভোটের অঙ্গীকার করছেন৷ লেবার পার্টির শতাধিক প্রার্থীর সঙ্গে টিউলিপও ‘রিমেইন লেবার ক্যাম্পেইন প্লেডজ’ নামের এক কর্মসূচিতে রয়েছেন। এর আওতায় তারা অঙ্গীকার করেছেন, ‘আমরা আবার গণভোট আয়োজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা চাই আপনারা আপনাদের চূড়ান্ত রায় দেওয়ার সুযোগ পান। আমি পুনরায় এমপি নির্বাচিত হলে, ইইউয়ে থাকার চেষ্টা করবো।’ ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতেও, জাতীয় ইস্যু হিসেবে এবার ব্রেক্সিটই নির্বাচনি আসনগুলোর জয়-পরাজয়ের প্রধান নিয়ামক হবে।