হুমকি দিয়েছে কারা!
    নগরীতে দেনার চাপে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু, দায়ী কে?

    আক্কাস উদ্দিন,  বাংলাদেশ মেইল ::

    ধারের টাকা পরিশোধের জন্য মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছেন আল ফালাহ ব্যাংকের ম্যানেজার আব্দুল মোরশেদ চৌধুরী। গত ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাচলাইশের হিলভিউ আবাসিক এলাকার নাহার ভবন থেকে এই ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

    পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, শুরুতে শেয়ার ব্যবসা পরে আমদানি – রপ্তানি  ব্যবসা করতে আপন ফুফাতো ভাই সাকিব থেকে ১২ কোটি ৬০ লাখ ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ শাখার আল ফালাহ ব্যাংকের ম্যানেজার আব্দুল মোরশেদ চৌধুরী। এই টাকার বিপরীতে ১৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা পরিশোধও করেছিলেন। একই ভাবে অন্য ফুফাতো ভাই জাবেদ ইকবাল থেকে ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা ধার নিয়ে মুল টাকার সাথে লভ্যাংশসহ পরিশোধ করেছিলেন ১৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। কিন্তু ধারের বিপরীতে জমা দেয়া ব্ল্যাংক চেকে টাকার অংক বসিয়ে বাড়তি লভ্যাংশ দাবি করে মোরশেদকে মানসিক চাপে রেখেছিলেন ফুফাত ভাইরা।
    জানতে চাইলে মোরশেদের বড়ভাই জানান,
    ধার নেয়া টাকার জামানত হিসেবে মোরশেদ
    দিয়েছিলেন স্ত্রীসহ নিজের যৌথ একাউন্টের ব্ল্যাংক চেক। এই খালি চেকই কাল হলো মোরশেদের। পাওনা টাকা পরিশোধের পরও মুল টাকার উপর প্রতিশ্রুত লভ্যাংশ আদায় করেছেন আরো ১৩ কোটি টাকা। তারপরও আমার ভাইকে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ কর্মকর্তা, কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতাকে দিয়ে নিয়মিত হুমকি দিতো। মৃত্যুর আগের দিনও হুমকি দেয়া হয়েছে। দেনার বোঝা বইতে না পেরে সে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। যেটা সে ডায়েরীতে লিখে গেছে। ‘

    জানা যায়, গত চার বছরে পারভেজ – সাকিবের হাতে বেশ কয়েকবার হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদ ও তার স্ত্রী। ইসরাত জাহানকে স্কুলের চাকুরী থেকে বের করে দেবার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন প্রোবেল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। যুবলীগের কয়েকজন নেতার প্রত্যক্ষ মদদে মোরশেদকে  এমএন টাওয়ারে ধরে নিয়ে  গিয়ে ব্ল্যান্ক স্টাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেয় পারেভেজ -সাকিব।

    এই ভাবে টাকা দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন তিনি। লভ্যাংশ্যের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে শুরু হয় শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন। শুরু হয় নানা মুখি হুমকিও। ব্যাংক ম্যানেজার মোরশেদ এমন যন্তনা সয্য করতে না পেরে বেছে নেন আত্নহননের পথ।

    ব্যাংক কর্মকর্তার এই আত্নহননের পেছনে তার ফুফাত ভাই পারভেজ ও সাকিবের নানা হুমকি ভয়ভীতি প্রদর্শনকে দায়ী করছেন মোরশেদের  স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা ইশরাত জাহান চৌধুরী। জানতে চাইলে তিনি জানান , মোরশেদের ফুফাত ভাইরা প্রভাবশালীদের দিয়ে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে অর্থ পরিশোধের জন্য মানসিক চাপ তৈরি করেছিলেন আত্নহত্যার আগের দিন ৬ এপ্রিলও যুবলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল হক রাসেল, মোরশেদকে টাকা পরিশোধ করতে হুমকি দিয়ে ফোন করেছিলেন। এই অডিও রেকর্ড সীতাকুণ্ডের সাংসদ দিদারুল আলমকে পাঠানো হয়েছে ঘটনার দিনই। এছাড়া আমার বাসায় একবার হামলা করে সন্ত্রাসীরা। সেখানে সন্ত্রাসীদের সাথে  আরশাদ বাচ্চু,  শ্যারন নামের প্রভাবশালী দুজন  নেতা ছিলেন।  তখন বিষয়টি নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অভিযোগ আকারে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন ডিসির অনুরোধে আমরা হামলার সাথে জড়িতদের মধ্যে রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের নাম বাদ দেই।

    এদিকে, মোরশেদকে ফোন করার করার কথা স্বীকার করলেও হুমকি দিয়ে মানসিক চাপ তৈরি করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতা রাসেল । অন্যদিকে ধার নেয়া টাকা পরিশোধ করার পরও ১৩ কোটি টাকা লভ্যাংশ পরিশোধ করেছিলেন দাবি মোরশেদের স্ত্রীর। পরবর্তীতে অতিিরিক্ত  লভ্যাংশ পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আব্দুল মোরশেদ থানায় মামলা করতে গেলে বাধা দেন সিএমপির উপ কমিশনার বিজয় বসাক।

    কিন্তু সিএমপির উপ পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক বলেন, ‘ টাকা পরিশোধ করতে চাপ দেবার মতো ঘটনা ঘটেনি। মোরশেদ মামলা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কেন করেননি সেটা আমার জানা নেই। ‘

    মানসিক চাপ তৈরি করে আত্নহননে বাধ্য করা হয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদকে -এমন অভিযোগ করে গত ৮ এপ্রিল নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন মোরশেদের বড় ভাই আব্দুল এরশাদ চৌধুরী। এ অভিযোগের ভিত্তিতে চারজনকে আসামী করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

    জানতে চাইলে উপ পুলিশ কমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমান জানান, ‘ আত্নহত্যায় প্ররোচিত করা হয়েছে এমন অভিযোগ করে ৩০৬,৫০৬ ধারায় মোরশেদের পরিবার মামলা দায়ের করেছেন। জাবেদ ইকবাল, পারভেজ ইকবাল,  সাকিব, রাসেল এ চারজনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত আরো আটজনকে মামলার আসামী করা হয়েছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার নির্দেশ দিয়েছি। ‘

    এদিকে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া আব্দুল মোরশেদ মৃত্যুর আগে সুইসাইট নোটে লিখে গিয়েছেন  দেনা পরিশোধের চাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন ‘

    পারছিনা সত্যি আর নিতে পারছি না প্রতিদিন একবার করে মরছি। এই দেনার ভার আর নিতে পারছি না।  ভুল মানুষের হাতে পরে যখন সত্যি কোন দেনা ছিল না, এসবের হাতে পড়ে সত্যিই আমি ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। অনেকবার মরার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। এই ভেবে ইনশাআল্লাহ এর থেকে বের হতে পারব একদিন । আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন আর একটু দেখি আর একটু দেখি করতে করতে দেনার গর্তটা অনেক বেশি বড় হয়ে গেছে। যারা কোন টাকায় পেতনা তাদের দিতে গিয়ে এখন সত্যিকারের দেনায় জর্জরিত। বেঁচে থাকলেই দেনা আরো বাড়বে। তাছাড়া পরিচিতগুলো এখন চেপে ধরেছে বেশি।    আর নিতে পারছি না,  সত্যি পারছিনা।  আমি আমার প্রতিটি ফ্যামিলি মেম্বারদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আমার দ্বারা তারা অনেক অপমান হয়েছে।  দুর্ভোগ পোহাতে হইছে। আমি ক্ষমা চাচ্ছি আমার দ্বারা অনেক কষ্ট পাইছে।  অপমান হয়েছে। জলি তুমি চোখকে দেখে রেখো।  জানি তুমি দেখে রাখবে।  অনেক অনেক খারাপ লাগছে। ভাই – ভাবি  পরিবারের জন্য অনেক খারাপ লাগছে।  আমার এই ঘটনার জন্য ওদের উপর অনেক কথা আসবে।  কিন্তু সত্যি বলছি আমি আর পারছি না।  কিছু লোকের নিত্য অমানুষিক প্রেসার আমি আর নিতে পারছি না।   সবাই আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিন।  প্লিজ সবাই জুমকে একটু দেখে রেখো।  আল্লাহ হাফেজ।

    করোনা পরিস্থিতিসহ সহ নানামুখী সমস্যার কারনে ধার নেয়া টাকার উপর লভ্যাংশ দিতে না পরে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদকে। তাকে আত্নহত্যায় প্ররোচিত করার পেছনে জড়িতদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবী নিহতের পরিবারের।

    জানতে চাইলে দিদারুল আলম জানান, হুমকি দেবার বিষয়টি স্পষ্ট। ভয়েস রেকর্ড রয়েছে। যে বা যারা হুমকি দিয়েছেন, হুমকি দিয়ে মানষিক চাপ তৈরি করেছেন।  এই আত্নহত্যার পেছনে যারা যারা দায়ী তাদের সবাইকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।