তালেবান সমর্থনে অনুতপ্ত পাকিস্তান?

মেজর জেনারেল (অবঃ) হর্ষ কাকর ::

তালেবান কর্তৃক আফগানিস্তান দখলের পর থেকেই উত্তাল গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি। তবে নিঃসন্দেহে এই ইস্যুতে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত বিষয় সন্ত্রাসবাদের বিস্তার এবং সেটি রোধে করণীয়। এরই সূত্র ধরে সম্প্রতি কাবুল গিয়েছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুইদ ইউসুফ।

যতদূর জানা যায়, আফগান রাজধানীতে তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে পাক নিরাপত্তা উপদেষ্টার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো নিজ নিজ দেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড রোধকল্পে করণীয়! আলোচনা শেষে তালেবান নেতৃত্ব ইউসুফকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে প্রতিবেশী দেশটিতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে আফগান মাটি ব্যবহারের অনুমতি দিবেন না তাঁরা। বিনিময়ে পাকিস্তানের কাছেও একই রকম দাবি করে আফগানিস্তান! পাকিস্তানও তাঁদের সে দাবি মেনে নেয়।

এখনও অবধি বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সকলেই পাক সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তালেবান নেতৃত্বের সখ্যতাই দেখে এসেছে। তবে মুদ্রার উলটো পিঠে প্রচলিত রয়েছে, তালেবান শাসকদের চাপে রাখতে ইসলামিক স্টেট (আইএসকেপি) জঙ্গিদের সমর্থন দিচ্ছে পাক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। একই ভাবে, অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও কিছু জঙ্গি গোষ্ঠীকে মদদ দিচ্ছে তালেবান নেতৃত্ব।

গত সপ্তাহেই পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে দুটি সামরিক ঘাঁটিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ৭ সেনাসহ ২০ জন নিহত হয়েছে। বালুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএফ) এ হামলার দায় শিকার করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ক্রমশ এমন ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে যে, বেলুচিস্তানের পাঞ্জগুর ও নোশকি জেলায় সেনা ক্যাম্পে চালানো হামলায় তালেবান মদদ ছিলো।

মার্কিন নিয়ন্ত্রণ থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করার পর তালেবান নেতৃত্বকে ক্ষমতায় বসানো অবধি পুরো কলকাঠি নেড়েছিলো পাক সরকার ও গোয়েন্দারা। ইসলামাবাদের বিশ্বাস ছিলো তালেবান নিয়ন্ত্রণে থাকা কাবুলকে সহজেই বাগে আনতে পারবে তাঁরা। সে সুবাদে বালুচ বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ সহ আফগানিস্তানের সঙ্গে থাকা বেশিরভাগ অসঙ্গতি দূর করণে কাজ করতে পারবে ইমরান সরকার। পাশাপাশি কাশ্মীরেও সন্ত্রাসী প্রেরণে তালেবানকে সহযোগী হিসেবে পাবার সম্ভাবনা ছিলো ইসলামাবাদের। কিন্তু ক্রমশই হয়তো সে সম্ভাবনার দুয়ার ফিকে হয়ে দাঁড়াচ্ছে পাকিস্তানের সামনে। আফগান নেতৃত্ব স্বাধীন সক্ষমতায় সরকার প্রতিষ্ঠাকল্পে দৃঢ়চেতা বলেই মনে হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান তালেবানের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খেয়েছে ডুরান্ড লাইনে বেড়া দেয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে। পাকিস্তানের কেকওয়াক করার কাজটি দৃঢ় হস্তে ভেস্তে দেয় তালেবান সৈন্যরা। ওই সীমান্তে পাক সেনাদের অস্ত্র সহ সবকিছু জিম্মায় নিয়ে নেয় তাঁরা। স্বাভাবিকভাবেই এই কাজে লজ্জায় লাল হয়ে যায় পাক সেনাবাহিনীর মুখ। কিন্তু তা সত্ত্বেও হলফ করে বলা যায়, মুখ বুজে মেনে নেয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো উপায় ছিলো না।

কাবুলের সাথে এসব ইস্যুতে বরাবরই সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে ইসলামাবাদ। কিন্তু তালেবানদের শত প্রতিশ্রুতির পরও কোনোটিরই সঠিক বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। মুখ রক্ষার খাতিরে বিশ্বের সামনে পাক নেতৃত্ব বলছে যে, একটি যৌথ কমিটি গঠন করে সন্ত্রাস নির্মূল করা হবে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি, সেটি বুঝাই যাচ্ছে।

এছাড়াও, হাক্বানী নেটওয়ার্ক ও আফগান তালেবানের সহযোগিতায় সম্প্রতি তেহরিক-ই-তালেবান-পাকিস্তানের সঙ্গে সংলাপে বসেছিলো পাক সরকার। সেখানে ১০০ টিটিপি জঙ্গিকে মুক্তির দাবি জানায় সংগঠনটি। কিন্তু পাক সরকার তা অস্বীকার করায় আলোচনা ভেস্তে যায়। ভবিষ্যতে হামলা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ।

এই সংলাপের পর থেকে পাকিস্তানে সহিংসতা কমার বদলে বরং বেড়ে গিয়েছে অনেকাংশে। যেখানে ২০২০ সালে টিটিপি ৯৫ টি হামলা চালিয়ে ১৪০ জনকে হত্যা করেছিলো, সেখানে ২০২১ সালে তালেবান কাবুলের ক্ষমতা দখলের পর থেকে প্রায় ২৯৪ টি হামলা চালিয়ে ৪০০ এর মতো মানুষকে হত্যা করেছে। এর বেশিরভাগই পাক নিরাপত্তা কর্মী।

গোপন সূত্রে জানা যায়, মার্কিন বাহিনী অত্র অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে ড্রোন হামলার আশঙ্কা কমায় নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে টিটিপি। এখানে প্রত্যক্ষ মদদ দিচ্ছে আফগান তালেবান। উপরন্তু, আফগানিস্তানে তালেবানের হাতে আসা মার্কিন অস্ত্রাদি অর্জনের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলেছে টিটিপি। সংগঠনটির নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ ইতোমধ্যে আফগান তালেবানের নিকট নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।

সর্বোপরি, টিটিপি ও তালেবান যে একই মায়ের সন্তান, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই আর সন্দেহের অবকাশ নেই বিশ্ববাসীর। অতীতেও তৎকালীন আফগান বাহিনী এবং মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছিলো এই দুই সংগঠন। পূর্বে সবসময়ই টিটিপির যেকোনো হামলার ক্ষেত্রে পাক সরকার ভারতীয় বাহিনীকে দোষারোপ করতো। দেশটির অভ্যন্তরের যেকোনো নাশকতামূলক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রেই প্রথম অভিযোগে বিদ্ধ করা হতো ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ কে।

কিন্তু, বর্তমানে আফগানিস্তান জুড়ে ভারতীয় বাহিনীর অনুপস্থিতিতে এবং পূর্বতন আফগান সরকারের সকল গোয়েন্দা পরিষেবা ভেঙ্গে পড়ায় কার্যত সকল নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতেই। ফলত, পাকিস্তান তার চিরাচরিত দোষারোপের সংস্কৃতিকেও আর কাজে লাগাতে পারছে না! ক্রমশ রুষ্ট হচ্ছে দেশটির জনগণ।

সকল গোয়েন্দা রিপোর্ট মোতাবেক, পশতুন অধ্যুষিত অঞ্চলে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে টিটিপির প্রভাব। পশতুন জাতীয়তাবাদকে বৃদ্ধি করছে তারা। ডুরাল্ড লাইনের উভয় পাশের পশতুন জাতিকে উত্তেজিত করতে ভূমিকা নিচ্ছে সংগঠনটি। পাক সীমান্তে থাকা পশতুন জাতির লোকেরা ইসলামাবাদের অনাচারের কল্যাণে নিজেদের আফগান ভাবতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে।

তবে, এতকিছুর পরও হয়তো বোধদয় ঘটছে না পাক সরকারের। পশতুন এবং বেলুচ উভয় সম্প্রদায়ের সঙ্গেই ১৯৭১ এর মতো ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে দেশটির সরকার। পাকিস্তান দুই দশক ধরে তালেবানদের সমর্থন দিয়েছিল শুধুমাত্র এই বিশ্বাসে যে তারা ক্ষমতায় ফিরে আসলে আফগানিস্তানে ভারতীয় প্রভাব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু, এখন যা হয়েছে বা হচ্ছে, সেটি গোটা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

যাহোক, টিটিপি এবং বেলুচ স্বাধীনতাকামীরা বর্তমান তালেবান সরকারের সময় আরও বেশি পরিমাণে স্বাধীনতা উপভোগ করছে, তা আর নতুন করে জানানোর কিছু নেই। কিন্তু, নিজেদের দরিদ্র অবস্থা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে এই আফগান সরকার টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করতে হবে।

সহজেই অনুমেয়, এক কঠিন গেরাকলে ফেঁসে গিয়েছে ইমরান খানের দেশটি। যদি তালেবান সরকার স্থিতিশীল না হয়, তাহলে খাদ্য ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে প্রচুর সংখ্যক আফগান শরণার্থী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে চলে আসবে। এতে ক্রমশ যেমন উদ্বাস্তু সমস্যা বৃদ্ধি পাবে, তেমনই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরও উত্থান হবে। মাদকের প্রভাবও দিনকে দিন অঞ্চলজুড়ে বেড়েই চলবে।

প্রকৃতপক্ষে, তালেবান শাসকেরা নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের দিকে মনযোগ দিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। পশ্চিমারাও সরাসরি তালেবান শাসকদের সাথেই সমঝোতা বৈঠক অব্যহত রেখেছে। এখানে ক্রমশ কমে যাচ্ছে পাক সরকারের ভূমিকা। তালেবানদের মুখপাত্র হিসেবে পাকিস্তানের কার্যক্রম এভাবেই হ্রাস পাচ্ছে!

পরিশেষে, পাক সরকার কর্তৃক তালেবানকে সমর্থন এবং তাদের চাপে রাখতে অন্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন, অন্যদিকে, তালেবান কর্তৃক পাক সরকারকে চাপে রাখতে টিটিপি ও বেলুচদের সমর্থন অঞ্চলটিতে ভূ-রাজনৈতিক খেলা জমিয়ে তুলেছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয়, এতে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে সন্ত্রাসবাদ।

আঞ্চলিক এই বিষাক্ত খেলায় ভারত বর্তমানে দূরত্ব বজায় রাখলেও স্বভাবতই জড়িয়ে পড়েছে চীন ও তুরস্ক। তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত বছরের অর্জন এভাবে ধুলোয় মিশে যেতে দেখে অস্বস্তি বোধ করছে পাক গোয়েন্দারা? তালেবান সমর্থনে কী একটুও অনুতপ্ত নয় পাকিস্তান?

লেখক: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। (লেখাটি ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে গৃহীত)

অনুবাদ: ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল, প্রতিনিধি, ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ