বিমসটেক এখনও প্রাসঙ্গিক নয়?

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ::

সম্প্রতি গত ৩০ মার্চে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে ভার্চুয়াল মাধ্যমে আয়োজিত হলো বে অফ বেঙ্গল মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন বা বিমসটেকের পঞ্চম শীর্ষ সম্মেলন। সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বিমসটেকভূক্ত সাত দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানগণ। এর ঠিক আগে সম্মেলনের প্রস্তুতি পর্যালোচনা ও ভবিতব্য নির্ধারণে ২৮ এবং ২৯ মার্চ কলম্বোতে বৈঠকে বসেছিলেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এসব সম্মেলন ও বৈঠকে বরাবরের মতোই অত্র অঞ্চলের সমৃদ্ধি, সংযোগ এবং নিরাপত্তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন বিমসটেক নেতৃত্ব। তবে সার্বিকভাবে, এবারের সম্মেলনে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি নিঃসন্দেহে বিমসটেককে আলাদা গুরুত্ব এনে দিয়েছে বিশ্বমঞ্চে।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পারি, সার্ক প্রতিষ্ঠারও প্রায় ১২ বছর পর ১৯৯৭ সালে বিমসটেক যাত্রা আরম্ভ করে এবং ইতোমধ্যে নিজের পথচলার ২৫ বছর পার করেছে। বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল এবং ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে সংগঠনটির। ভূ-রাজনীতির খেলায় সার্ক বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে রয়েছে। এমতাবস্থায়, বিমসটেক নিঃসন্দেহে সার্কের বিকল্প হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

আমরা সকলেই জানি, গঠন প্রকৃতি বিবেচনায় বিমসটেক একটি সেক্টর চালিত আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। অর্থাৎ, সহযোগিতার নির্দিষ্ট কিছু খাতে কাজ করে থাকে সংগঠনটি। এবারের শীর্ষ সম্মেলনের আগে সহযোগিতার ১৪ টি সেক্টর নির্ধারিত ছিলো, যার প্রতিটিতে সদস্য কোনো রাষ্ট্র অগ্রণী বা নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব পালন করতো।

এই ১৪ টি সেক্টর ও এর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য রাষ্ট্রসমূহ যথাক্রমে, ১। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ – বাংলাদেশ, ২। জলবায়ু পরিবর্তন – বাংলাদেশ; ৩। পরিবহন ও যোগাযোগ – ভারত, ৪। পর্যটন – ভারত, ৫। কাউন্টার-টেরোরিজম এবং ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম – ভারত, ৬। পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা – ভারত, ৭। শক্তি -মিয়ানমার, ৮। কৃষি – মায়ানমার; ৯। প্রযুক্তি – শ্রীলঙ্কা; ১০। মৎস্য-থাইল্যান্ড, ১১। জনস্বাস্থ্য – থাইল্যান্ড; ১২। মানুষে মানুষে যোগাযোগ – থাইল্যান্ড; ১৩। দারিদ্র্য বিমোচন – নেপাল; এবং ১৪। সাংস্কৃতিক সহযোগিতা – ভুটান।

কিন্তু, এবারের সম্মেলন শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এই সহযোগিতার ক্ষেত্র ১৪ থেকে কমিয়ে ০৭ এ নিয়ে আসা হবে এবং এই সাত স্তম্ভের নিরাপত্তা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিবে ভারত।

লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সময়টি নানান বৈশ্বিক ঘটনার ঘনঘটায় আবৃত। মহামারী পরবর্তী বিশ্ব যখন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় মরিয়া, সাম্প্রতিক ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে যেখানে বাজারদর ব্যাপকভাবে অস্থিতিশীল, বিশ্ব শক্তিগুলো যেখানে এঁকে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বাক্যবাণ ছুড়ছে, এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো এবারের বিমসটেক সম্মেলন। এমন প্রেক্ষাপটে বিমসটেকের নিরাপত্তা স্তম্ভের দায়িত্ব নেয়া নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জের বিষয়।

সম্মেলনে অংশ নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “ইউরোপের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক সহযোগিতাকে আরও বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের সবার উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য আজ আমরা বিমসটেক চার্টার গ্রহণ করছি।”

বৈশ্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেই আমরা দেখতে পাই, ইউরোপের সাম্প্রতিক সংঘাত এবং এর দরুন যুক্তরাষ্ট্র সহ মিত্রশক্তিগুলোর রাশিয়ার উপর এক তরফা নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতিতে পড়েছে বিমসটেক সদস্য দেশগুলো। আন্তর্জাতিক এ ধরণের নিষেধাজ্ঞার বাস্তবিক কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু, রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য এহেন হাতিয়ার পূর্বেও ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা দেশগুলো। এমতাবস্থায়, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাড়ছে খাদ্য ও ভোজ্য তেলের দাম। বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতির চাপ। মহামারী থেকে উত্তরণের ঠিক পরপরই এমন সাংঘর্ষিক ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতিকে এক গভীর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে।

এবারের বিমসটেক এজেন্ডায় স্বাস্থ্য খাতের উপর এবং সকল বয়সী লোকদের কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে টিকাদানের উপর জোর দেয়া হয়েছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর জন্য পর্যটন শিল্প যেনো পুনরায় জীবন ফিরে পায়, সেটি নিশ্চায়নের উপর জোর দেয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মশক্তির পুনঃদক্ষতা এবং কর্মসংস্থান এর উপর ব্যাপক জোর দেয়া হয়েছে এবারের সম্মেলনে, কেননা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সমাজের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির চালিকাশক্তি। ধারণা করা হচ্ছে, বিমসটেকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা দৃঢ় হবে।

এবারের বিমসটেক সম্মেলনের থিম ছিল ‘একটি স্থিতিশীল অঞ্চল গড়তে সমৃদ্ধ অর্থনীতি, সুস্থ মানুষ’। প্রতিষ্ঠানটির সদস্য দেশগুলো যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, এবারের স্লোগানেও সেই বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বের খবরাখবর রাখেন, এমন ব্যক্তিমাত্রই বর্তমানে শ্রীলঙ্কার দুর্দশার কথা সম্পর্কে জানেন। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈটিক সঙ্কট ও বিপদের মুখোমুখি হয়েছে দেশটি। ভারত প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতা সহ সম্ভাব্য সব ধরণের সাহায্য করছে দেশটিকে। নয়াদিল্লী ইতোমধ্যে ব্যাপক অর্থ অত্যন্ত স্বল্প সুদে লোনও দিয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। শ্রীলঙ্কা এমন একটি দেশ, যার অর্থনীতি মূলত পর্যটন এবং চায়ের রপ্তানির উপর নির্ভরশীল ছিল, মহামারী, বৈদেশিক ঋণের চাপ এবং সাম্প্রতিক সঙ্কটে একদমই ঘায়েল হয়ে পড়েছে!

এবারের সম্মেলনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বিমসটেককে শক্তিশালী করতে এর সচিবালয়ে প্রায় ১০ লাখ ডলার দেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। পাশাপাশি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বিমসটেক স্কলারশিপ প্রোগ্রাম চালুর কথাও জানান তিনি। এতে স্পষ্ট যে, ভারতও বিমসটেককে মূলধারার সংগঠনে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে এবারের সম্মেলনটি বিশেষ হয়ে থাকবে গৃহীত সনদের জন্য। বহু সময় বিলম্বের পর অবশেষে গৃহীত হয়েছে বিমসটেক সনদ। মহাসড়ক সংযোগ মাস্টারপ্ল্যান সহ বিভিন্ন ইস্যু এতে স্থান পেয়েছে। সর্বোপরি, আঞ্চলিক সংযোগ, সহযোগিতা এবং নিরাপত্তার গুরুত্বের উপর জোর দেয়া হয়েছিলো এবারের সম্মেলনে।

বিমসটেক নেতৃত্ব নিম্নলিখিত বিষয়াদিতে তদারকির চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন:

· ফৌজদারি বিষয়ে পারস্পরিক আইনি সহায়তার উপর বিমসটেক কনভেনশন

· কূটনৈতিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে বিমসটেক সমঝোতা স্মারক

· বিমসটেক প্রযুক্তি স্থানান্তর সুবিধা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে স্মারকলিপি।

গত দু-তিন বছরে বেকার হওয়া লক্ষাধিক লোক তাদের জীবিকা অর্জনের জন্য অবৈধ কার্যকলাপে যেতে পারে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, জলদস্যুতা, মাদক চোরাচালান, মানব পাচার, অবৈধ মাছ ধরার মতো আন্তঃজাতিক অপরাধ বাড়তে বাধ্য। তাই স্পষ্ট যে নিরাপত্তা ইস্যুতে এবার বেশ জোর দিয়েছে বিমসটেক।

তাছাড়া, মহামারীতে যেভাবে সকল স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে গিয়েছিলো, তা আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে ডিজিটাল বিশ্বের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই, এবারের সম্মেলনে ডিজিটাল ওয়ার্কস্পেসকে নিরাপদ করতে সাইবারস্পেস নিরাপত্তা অগ্রাধিকার পেয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরও অধিক মনোনিবেশ করতে সম্মত হয়েছে বিমসটেক রাষ্ট্রগুলো। পাশাপাশি যেকোনো পরিবেশগত দূর্যোগ মোকাবেলায় আগের চেয়ে আরও ঐক্যবদ্ধভাবে তা মোকাবেলার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছে রাষ্ট্রগুলো।

ভূ-রাজনীতি সবসময়ই যেকোনো আঞ্চলিক সংস্থার উপর ছায়া ফেলেছে। মায়ানমারের সামরিক জান্তার উপর চাপ বাড়াতে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন থেকে মায়ানমারের সামরিক সরকারকে বাদ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই চাপ প্রয়োগ করছিলো। এই অযৌক্তিক চাপ স্বাভাবিকভাবেই প্রতিহত করা হয়েছে।

ভারতের বিবৃতি স্পষ্ট করেছে, মায়ানমার সংস্থার সদস্য এবং ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য দেশটিকে কোনোভাবেই বৈঠক থেকে বাদ দেওয়া যাবে না। তবে, অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের থেকে ভিন্ন ভাবে এবারের সম্মেলনে মায়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

বলার অপেক্ষা রাখেনা যে মায়ানমারকে বাদ দিলে একদিকে যেমন রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলা যাবেনা, একইভাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে বিদ্রোহ মোকাবেলাতেও মায়ানমারের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে ভারতের। চীন এবং পাকিস্তান শুরু থেকেই ভারতকে ঘায়েল করতে এককাট্টা। এমতাবস্থায়, মায়ানমারকে একঘরে করার মানে চীন ও পাকিস্তানকে প্রশ্রয় দেয়া বৈ কিছু নয়! তাই এবারের সম্মেলনে মায়ানমারকে অন্তর্ভূক্ত করে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে বিমসটেক নেতৃত্ব।

এসবের পাশাপাশি, আশিয়ানের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিতেও বিমসটেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। ভারতের উন্নয়ন অংশীদারিত্বের উদ্যোগগুলো, যথাঃ আঞ্চলিক সংযোগ, শক্তি উন্নয়ন, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোতে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বিমসটেক। তাই বলা যায়, বিমসটেক এখন আর অলীক কোনো গল্প নয়। বরং, দৃশ্যত বাস্তব।

লেখক: ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার। (লেখাটি ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক থেকে গৃহীত)

অনুবাদ: ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল, বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক