দূর্নীতির আস্তানা চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল
জালিয়াতি করে পাঁচ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা তুলে নেয়ার চেষ্টা

বিশেষ প্রতিনিধি ::

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দূর্নীতির নানা কৌশল সামনে এসেছে বিভিন্ন সময়। ২০১৪ সালে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কিনে ৯ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৫ টাকা আত্মসাৎ করার ঘটনায় জেলও কেটেছেন সাবেক সিভিল সার্জন ডাঃ সরফরাজ খানসহ সাত আসামি ।

কিন্ত ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে অতীতের দূর্নীতির বিছানো জাল যেন কোনভাবেই ছিঁড়া সম্ভব হচ্ছে না। ২০১৪ সালের আলোচিত দূর্নীতির ঘটনায় দুদকের মামলা শেষ না হলেও সামনে এসেছে  অভিনব কৌশলে নতুন জালিয়াতির তথ্য।

দুইটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যয়খাতও ভিন্ন- তবুও ভুয়া স্মারক ব্যবহার করে পাঁচ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকার জালিয়াতির চেষ্টা, শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েছে চট্টগ্রাম  বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে। দূর্নীতি দমন কমিশনে ( দুদক) এই ব্যয় সম্পর্কিত মামলার শুনানি চলাকালীন সময়ে বকেয়া বিল তুলে নেয়ার অভিনব জালিয়াতির ঘটনাটি ঘটেছে একই হাসপাতালে।

মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরবরাহের বকেয়া বিল (২০১৩-১৪) পরিশোধে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেয় একটি চক্র৷ জালিয়াতির পুরো দায় ঠিকাদার মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের উপর চাপিয়ে আড়াল করা হয়েছে ঘটনার সাথে  জড়িত হাসপাতালটির হিসাবরক্ষন কর্মকর্তা ফোরকানকে। এমন জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হলে তোলপাড় শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে জেনারেল হাসপাতালে অতিরিক্ত দামে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সাথে জড়িত সাতজনের মধ্যে মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী  মুন্সি ফারুকের নামও ছিলো। ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জনের পাশাপাশি ওই সময়  চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটসোর্সিং খাতে নিয়োজিত জনবলের বেতন-ভাতা পরিশোধের আদেশ সংক্রান্ত স্মারক ব্যবহার করে  চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বিল জালিয়াতির ঘটনার সাথে জড়িত হিসাবরক্ষক মো. ফোরকানকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জালিয়াতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি দায়সারা আদেশ নিয়ে আড়াল করেছেন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন খালেদের অপরাধকে।

জালিয়াতির বিষয়টি জানাজানি হলে বুধবার এক অফিস আদেশে হাসপাতারের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নাছির উদ্দিন খালেদকে ফোরকানের জায়গায় অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে দায় সেরেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সুত্রমতে, ভুয়া স্মারক ব্যবহার করে নজিরবিহীন  এমন জালিয়াতিতে জড়িত হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ফোরকানকে বাঁচাতে মরিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জালিয়াতির পুরো দায় ঠিকাদারের ওপর চাপিয়ে ফোরকানকে এমন অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সুত্রটি জানায় , ভুয়া বিল তুলতে যে স্মারক নম্বরটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি মুলত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটসোর্সিং খাতের বিল সংক্রান্ত আদেশের। আউটসোর্সিং খাতে কর্মরত  জনবলের বেতন-ভাতা পরিশোধের স্মারক ব্যবহার করে অভিনব কায়দায় জালিয়াতির করেছে সংঘবদ্ধ একটি সিন্ডিকেট।

জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আটটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যা, আইসিইউ ভেন্টিলেটর ও কার্ডিয়াক পেশেন্ট মনিটর কেনার ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার একটি বিল মামলা জটিলতায় বকেয়া রয়েছর। দুদকের করা মামলাটি এখনো শুনানির পর্যায়েই রয়েছে।

গত ২৬ জুন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব সুশীল কুমার পালের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে একটি ব্যয় অনুমোদনের আদেশ তৈরি করা হয়। আদেশে ব্যবহার করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যয়ের ভিন্ন একটি স্মারক নম্বর। সেই স্মারক নম্বর ব্যবহার করে ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বকেয়া বিলটি ছাড়ের জন্য প্রস্তুত করেন জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মো. ফোরকান।

যেখানে স্বাক্ষর করেছেন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ সেখ ফজলে রাব্বি । গত মঙ্গলবার বিলটি নিয়ে বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে যান তিনি। কিন্তু পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিলটি ভুয়া বলে প্রমাণ পায় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রামের হিসাবে নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানান, হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে ফোরকানকে পুলিশে দেওয়া হলেও জেনারেল  হাসপাতালের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না দেওয়ায় তত্ত্বাবধায়কের জিম্মায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ।

বিলের সঙ্গে জমা দেওয়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ব্যয় মঞ্জুরিপত্রটিও ভুয়া বলে বুধবার এক চিঠিতে জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সুশীল কুমার পাল। চিঠিতে জালিয়াতির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হলেও দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে  প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহন করে আইনি ব্যবস্থা থেকে বাঁচানো চেষ্টা করা হয়েছে।  বুধবার (২৯ জুন) এই ঘটনার সাথে জড়িত জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ফোরকানকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে দায় সেরেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘ বৃহস্পতিবার মামলা করা হবে থানায়। আমরা বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারি।  মামলা দায়েরের বিষয়টি তো আমাদের না। কাল জানতে পারবেন  কাকে কাকে আসামি করা হয়েছে। ‘

তবে, পুলিশের কাছ থেকে হিসাবরক্ষক ফোরকানকে নিজের জিম্মায় ছাড়িয়ে আনার বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি নন জেনারেল হাসপাতালের এই তত্ত্বাবধায়ক।

হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে  কোনো আইনি ব্যবস্থা না  নেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারন সম্পাদক এডভোকেট আকতার কবির বলেন, ‘ ভুয়া স্মারক ব্যবহার করে এমন অভিনব জালিয়াতির ঘটনায় জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা দায় এড়াতে পারেন না। আইনি পদক্ষেপ না নিয়ে পুলিশ থেকে ছাড়িয়ে আনা ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। ঠিকাদারের উপর দায় চাপানো ছাড়া কি আর করবে। একজনকে ধরলে তো অনেকের নাম বের হয়ে আসবে৷ ‘

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ২০১৪ সালে ৯ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৫ টাকা যন্ত্রপাতি কেনার নামে অর্থ-আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলা শেষ হয় নি। নতুন করে আলোচনায় আসা মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মুন্সি ফারুকও সেই আলোচিত দূর্নীতি মামলার আসামী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন,  এখনও জেনারেল হাসপাতালের পুরোনো সিন্ডিকেট কৌশল পাল্টে চালিয়ে যাচ্ছে সরকারি অর্থ লোপাটের মিশন।