দেশ বিদেশে জ্বালানির মুল্য নির্ধারণ নীতি

বাংলাদেশ মেইল ::

যেকোনো অর্থনীতিতে জ্বালানির দামের ওঠানামা সবসময়ই উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন প্রধান দেশের ক্ষেত্রে। শক্তি খাত একটি দেশের সমস্ত উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভিত্তি তৈরি করে, কারণ এটি অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির একটি অনিবার্য উপাদান। , আমাদের শক্তির চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানির উপর নির্ভর করতে হবে তাই এর দাম ওঠানামার জন্য পরিকল্পিত নীতিমালাই উপযুক্ত হবে । সাধারণত অনেকগুলি প্যারামিটার রয়েছে যেগুলি জ্বালানীর দাম নির্ধারণ করে, বিশেষ করে অপরিশোধিত তেলের দাম। চাহিদা ও যোগান, ঘাটতি ভাড়া, আমদানি ব্যয় ও স্টোরেজ খরচ ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিচার বিশ্লেষণ করে প্রতিটি দেশ জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করে থাকে ।

আমাদের দেশের পেট্রোল, ডিজেল এবং তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজির দামের ব্যবস্থাপনাকে ঘিরে রযেছে নানা প্রশ্ন, নানা অব্যবস্থাপনা । সাম্প্রতিকসময়ে জ্বালানি তেলের যে দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে সেটির পেছনে আইএমএফ’ থেকে প্রাপ্তির শর্তের চেয়ে দেশের অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে৷ বিভিন্ন সময়ে এমন মূল্য পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার জন্য স্থগিত রাখা হয়েছিল। যেমন গত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে । এতে কোন সন্দেহ নেই যে তিনটি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত তেল বিপণন সংস্থার অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে গেল ছয় মাস পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লোকসান দিয়েছে। তাছাড়া বিপিসি লোকসান দিলেও সরকার জ্বালানি তেলের আমদানির উপর শুল্ক আদায় করে ঠিকই লাভবান হয়েছে। উদ্ভব পরিস্থিতিতে বেসরকারিভাবে জ্বালানী তেল আমদানির অনুমতি দেয়া উচিত বলে মনে করছেন জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকরা। জ্বালানি খাতে সরকার শাসিত মূল্য প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে গেলে এবং কোম্পানিগুলি তাদের পাম্পে তাদের নিজস্ব মূল্য নির্ধারণ করে জ্বালানি তেল বিক্রি করতে পারবে। বেসরকারিভাবে আমদানির ক্ষেত্রে একজন সফল আমদানিকারক সর্বোচ্চ লাভের জন্য দাম নির্ধারণ করতে চাইবে — এবং এটি আশা করা যায় সেক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের দাম নায্য হবে। বর্তমানে সরকারী নীতির কারনে জ্বালানির বিস্তৃত বাজারকে উপভোগ করা হচ্ছে না। এই মুহুর্তে, অপরিশোধিত তেলের দাম এবং উচ্চ দেশীয় করের উপর বিশ্বব্যাপী চলমান “আন্ডার-রিকভারি”- চলছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন জ্বালানি মূল্যের নীতি অনুসরণ করলেও এখন দেশটিতে জ্বালানি তেলের দাম সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণমুক্ত। পেট্রোলের দামকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হয়েছিল ২০১০ সালে এবং ডিজেলের ক্ষেত্রে সেটি ২০১৪ সালে কার্যকর হয়। তবে জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকরা বলে থাকেন ভারতের এই উদারনীতির কারণে দেশটিতে জ্বালানির দাম বেড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডা, চীন -চারটি দেশেই জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ সুনির্দিষ্ট কৌশল রয়েছে।

সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলের দামে $ ১০ বৃদ্ধির বিপরীতে এক গ্যালন গ্যাসোলিনের গড় খুচরা মূল্যের ২৫ সেন্ট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। এটি শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদী বা বড় কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রুড ওয়েলের দাম বৃদ্ধির প্রবণতার জন্য এমন কৌশল ব্যবহৃত হয় দেশটিতে । মৌসুমী কারণগুলিকে বাদ দিয়ে এভাবেই পেট্রোল -ডিজেল-অকটেনের খুচরা দাম ঠিক করা হয়। ক্রুড অয়েলের দাম কমলে আবার দাম পুননির্ধারনও করা হয়৷

আর যুক্তরাজ্যে জ্বালানীর দামও ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দামের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ট্র্যাক করে নির্ধারন করা হয়, যেমনটি বিশ্ব বাজারে করা হয়। তবে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান বলছে, এই বাজারগুলি যুক্তরাজ্যের আর্থিক আচরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।পাইকারি, বিতরণ খরচ এবং খুচরা মার্জিন – যা খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ক্রয় করা পেট্রোল বা ডিজেলের খরচের সাথে শিপিং খরচ এবং স্টোরেজের সাথে জড়িত খরচ ( জ্বালানি পৃথক পৃথক স্থানে পৌঁছে দেওয়া) এবং প্রতিটি লিটারে প্রকৃত মার্জিন (লাভ)৷

বৃটিশ সরকারের নির্ধারিত জ্বালানি শুল্ক এবং ভ্যাট উভয়ই তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল , যা যুক্তরাজ্যে জ্বালানির দামের সাথে জড়িত । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাজ্যে জ্বালানি শুল্ক ২০১০ সাল থেকে ফ্রিজ করা আছে। বর্তমানে এটি প্রতি লিটারে ৫৭.৯৫ পেন্স । জ্বালানির ভ্যাটও মোটামুটি স্থিতিশীল , যা ২০% । সামগ্রিকভাবে, পাম্পগুলিতে যে টাকায় জ্বালানি বিক্রি করা হয় সেটি সাধারণত শুল্ক এবং ভ্যাটের প্রায় ৭২ শতাংশসহ । প্রতি লিটার তেলের দামের অবশিষ্ট ২৮ % খুচরা বিক্রেতার খরচ এবং লাভের মার্জিন । তাই বৃটেনের পাম্পগুলোতে, খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে জ্বালানির দামে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায় ।
যুক্তরাজ্য জ্বালানির দাম নির্ধারণ করার কোনো একক সংস্থা নেই। জ্বালানির দাম দেশটির খুচরা বিক্রেতাদের উপর নির্ভর করে, তারা লাভের যে মার্জিন পেতে চায় তার উপর ভিত্তি করে দাম নির্ধারণ করে৷

এই কারনে দেশটিতে জ্বালানির পাম্প মূল্য তাই দৈনিক ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়৷ তেলের দামের ওঠানামা পাম্পের দামের উপর প্রভাব ফেলে। সরকার আরোপিত শুল্ক বা ভ্যাটের কোনো পরিবর্তন হবে কিনা সেটি সিচুয়েশনের উপর নির্ভর করে । মানে হলো, বৃটেনের জ্বালানি তেলের দাম দেশটির প্রতিটি খুচরা বিক্রেতার উপর নির্ভর করে৷ তারা দিনশেষে ভোক্তাদের উপর কোন খরচ বৃদ্ধি বা হ্রাস করতে চায় কিনা সেটির উপর দামের উঠানামা নিয়ন্ত্রিত হয়৷

অন্যদিকে, কানাডায় জ্বালানি তেলের দাম কানাডিয়ান সরকারের নির্ধারণ করা ট্যাক্সের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে কানাডার তিনটি সিটি কাউন্সিল জ্বালানির উপর আলাদা করে শুল্ক বসিয়ে টাকা নেয় । ১৯৭০ -এর দশক থেকে ৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে, পেট্রল এবং অন্যান্য জ্বালানির জন্য কানাডিয়ান ভোক্তাদের পরিশোধিত মূল্য ‘সরকারি মূল্য’ নিয়ন্ত্রণের অধীন ছিল। ১৯৮৫ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে কানাডিয়ান সরকার জ্বালানির দামের উপর নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নেয়, যাতে পেট্রোলিয়াম পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

ফেডারেল সরকার গ্যাসোলিনের উপর প্রতি লিটারে দশ সেন্ট হারে আবগারি শুল্ক আদায় করে যেটি ১৯৯৫ সালের পর থেকে একই হারে কার্যকর রয়েছে। এবং ডিজেলে প্রতি লিটার ৪ সেন্ট শুল্ক জড়িত, এই হারও ১৯৮৭ সাল থেকে অপরিবর্তিত আছে । আর দেশটিতে ফার্নেস তেলকে এমন কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। একইভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস বা প্রোপেনের উপর কোন ফেডারেল আবগারি কর নেই।

বর্তমানে প্রাদেশিক সরকারগুলি পেট্রোল এবং ডিজেলের করও সংগ্রহ করে। প্রদেশ অনুসারে যথেষ্ট পরিবর্তিত হয় করের হার। শেষ পর্যন্ত, কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, ভিক্টোরিয়া এবং মন্ট্রিল এই তিনটি সিটি কাউন্সিল পেট্রোলের উপর কর প্রয়োগ করেছে।

তবে দেশটিতে সেলস ট্যাক্স রয়েছে। এই ট্যাক্স খুচরা মূল্যের শতাংশের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। এই পদ্ধতিটি ‘বিজ্ঞাপন মূল্য’ হিসাবে পরিচিত। ফেডারেল জিএসটি/এইচএসটি অপরিশোধিত তেল সংগ্রহের খরচ এবং পরিশোধন খরচের সাথে বিপণন খরচ এবং খুচরা বিক্রেতার মার্জিন, ফেডারেল আবগারি কর, প্রযোজ্য ফেডারেল এবং প্রাদেশিক কার্বন শুল্ক, প্রাদেশিক সড়ক করসহ সব ধরনের খরচ যোগ করে জ্বালানির মুল্য নির্ধারণ করে৷

তবে, কানাডায় প্রাদেশিক সেলস ট্যাক্স পেট্রল বা ডিজেলের মতো জ্বালানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ বাজারে তাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিক্রয় কর (HST) এবং কুইবেকে (QST) কার্যকর রয়েছে।

চীনারা জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে ২০০৯ সালে প্রবর্তিত একটি নতুন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে থাকে।
বিশ্ববাজারে ২২ দিনের চলমান অপরিশোধিত তেলের দামের একটি busket এর গড়ের উপর ভিত্তি করে চীন জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করে । যখন গড় দাম প্রতি ব্যারেল $ ৮০ ডলারের নিচে থাকে, তখন দাম তুলনামূলকভাবে অবাধে চলে যায় এবং রিফাইনাররা “স্বাভাবিক” মার্জিন অর্জন করবে বলে আশা করা হয়। ৮০ $ থেকে ১৩০ $ দামের মধ্য দেশটির তেল পরিশোধকরা আর লাভ করে না। দাম $ ১৩০ ডলারের উপরে গেলে , অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানির দাম কম রাখতে ট্যাক্স ব্যবস্থা ব্যবহার করা হয় চীনে।

যদিও দেশটি জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে ক্রুড ওয়েলের ২২-দিনের গড় প্রাইস ইনডেক্স ব্যবহার করে কিন্তু পূর্ববর্তী মূল্য-নির্ধারণ স্তর থেকে নতুন দাম ৪ % এর বেশি পরিবর্তন হলে মূল্য সমন্বয় শুরু করে সরকার।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে প্রায়শই জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি বাস্তবায়নে বিলম্ব করে সরকার । ২০০৮ সালে মাত্র তিনবার খুচরা মূল্য পরিবর্তন করা হয়েছিল, ২০০৯ সালে আটবার, ২০১০ সালে চারবার, ২০১১ সালে তিনবার এবং ২০১২ সালে আটবার ( অর্ধেক দাম কমানো হয়েছিল)। ২০১১ সালের জুলাই মাসে চীনা সরকার আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে। এরআগে ডিজেল এবং জেট ফুয়েলে ৬ % শুল্ক এবং পেট্রলে ৫% শুল্ক ছিলো। বাকি জ্বালানী তেলে যেগুলোর পুর্বশুল্ক ৩% ছিলো সেগুলিকে ১% এ কমিয়েছিল। আগস্ট ২০১১ সালে আগস্ট মাসে , সরকার জেট ফুয়েলের দামের মাসিক সমন্বয়ে শুরু করে।

চীন সরকার ২০০৮ সালে জ্বালানি আমদানির উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাতিল করে এবং ২০১১ সালের অক্টোবরে তেল ও গ্যাসের উপর ৫ শতাংশ বিক্রয় কর ঘোষণা করে । মূল্য নির্ধারণের জন্য উদাহরণ তৈরি করা প্রস্তাবটিতে তেল কোম্পানিগুলিকে বিশ্ব তেলের দাম হিসাবে স্থানীয় বাজারে মূল্য নির্ধারণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে । তবে ব্যারেল প্রতি দাম US $ ৪০ থেকে US$ ১৩০ এর মধ্যে হলে, প্রাইস ইনডেক্সের গড় সময়সীমাকে দশ দিনে নামিয়ে আনা হয়। বিশ্ব বাজারে ঘন ঘন দাম পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যের রেখে জ্বালানি তেলে ফর্মুলা-ভিত্তিক মূল্য সমন্বয়ের উদাহরণ তৈরি করেছে চায়না।