মেয়াদ উত্তীর্ণ সাবান বিক্রি হবে বাজারে
কাস্টমসে ‘ নিলামের আড়ালে’ শুল্ক ফাঁকির খেলা

ওয়াহিদ জামান :::

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্যে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্ত আমদানি করা পণ্যের কনটেইনার ছাড় না করিয়ে পরিকল্পিতভাবে দুইবছরের মধ্যে সেসব কনটেইনার নিলামের মাধ্যমে কিনে নিয়ে পুনরায় বাজারজাত করা হচ্ছে। নিলাম শেড খালি করার সিদ্ধান্তের আড়ালে আমদানি করা পণ্যে রাজস্ব ফাঁকি দেবার কূটকৌশলে সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে একশ্রেণির অসাধু আমদানিকারক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আমদানি করা পণ্যের কনটেইনার ছাড় না করে পরিকল্পিত ভাবে নিলামের মাধ্যমে স্বল্পদামে কিনে নিয়ে আবার বাজারে ছাড়া হচ্ছে একই পণ্য। মোড়ক পরিবর্তন করে গুঁড়ো দুধ, সাবান, টিস্যু, শিশুখাদ্যের মতো স্পর্শকাতর মেয়াদউত্তীর্ণ পণ্য বাজারজাত করে বিপুল মুনাফা উপার্জনের এই খেলা যেন হার মানিয়েছে ভারতীয় ছবির কাহিনিকেও।

চট্টগ্রাম বন্দরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বন্দরের নিলাম শেডে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, কনটেইনারসহ নষ্ট হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া বিভিন্ন পণ্য কিংবা গাড়ি, পরিত্যক্ত পণ্য নিলামে বিক্রি করার কথা। সুত্রমতে, চট্টগ্রাম বন্দরের নিলাম শেডকে ভাগাড়মুক্ত করার সিদ্ধান্তের আড়ালে চলছে ‘ বাণিজ্য জুয়া ‘। সুত্রমতে, ধংসের তালিকায় থাকা পণ্যও ধংস না করে তুলে দেয়া হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে। নিলামযোগ্য পণ্য সরিয়ে নিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সালে বন্দরের বাইরে নতুন নিলাম শেড স্থাপন করলেও সাত বছর সেই গুদামে পণ্য স্থানান্তর করেনি চট্টগ্রাম কাস্টমস। অসংখ্য চিঠি চালাচালির পর ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয় স্থানান্তর প্রক্রিয়া। অসাধু কাস্টম কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে পরিত্যক্ত পণ্যের কনটেইনার স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে ‘বাণিজ্য জুয়া ‘র গুটি হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী।

সুত্রমতে, এসব কনটেইনার আমদানিকারকরাই নিলামে অল্পদামের কিনে বাজারজাত করছে। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে। এরআগে আমদানিকারকদের মধ্যে যারা পণ্য নিয়ে যেত না, নির্দিষ্ট সময় পর সেগুলোর স্থান হতো এই নিলাম শেডে। অথবা মামলাসংক্রান্ত কোনো জটিলতার কারণেও পণ্যগুলো নিলাম শেডে রাখা হতো। কাস্টমসের নিয়ম অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের পর (৩০ দিন) কাস্টমস নিলাম শাখা এসব পণ্য নিলামে বিক্রি করে থাকে। কিন্তু যথাসময়ে নিলাম না হওয়ায় কিংবা নানাবিধ জটিলতার কারণে প্রায় অর্ধশত বছর পুরনো মালামালও এই নিলাম শেডে রয়ে গেছে। আর নিলাম শেডে থাকা কনটেইনার নিলামের মাধ্যমে শত কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ মিলেছে।

যদিও বন্দরে ১৯৬০, ৭৪ ও ৮৪ সালে আসা ৪৬০ কনটেইনারভর্তি রাসায়নিক পদার্থও রয়েছে, যেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিভিন্ন সময়ে বন্দরের গঠিত কমিটির রিপোর্টে উঠে এসেছে। এ ছাড়া ২০২০ সালে বন্দরের ইয়ার্ডের ভেতরে অগ্নিকা-ের পর এসব পণ্য নতুন নিলাম শেডে নিয়ে যাওয়ার জোরালো দাবি ওঠে। এই সিদ্ধান্তকেই বাণিজ্যের গুটি হিসেবে ব্যবহার করছে কাস্টমস কর্মকর্তা ও অসাধু আমদানিকারকরা।

জানা যায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও বন্দরের বিভিন্ন শেড (মালামাল রাখার জায়গা) থেকে পুরনো পণ্য সরিয়ে নেওয়ার কথা উঠলে গতি পায় কাস্টমসের পুরনো নিলাম গুদাম সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া। কিন্তু নিলাম শাখার কর্মকর্তাদের দৃস্টি পুরোনো ব্যবহার অযোগ্য কনটেইনারে নয়, সাম্প্রতিক আমদানি করা কনটেইনারের দিকে।সুত্রমতে, নিলামে কেনা এসব কনটেইনার ভর্তি পণ্যের মেয়াদ শেষ হলেও পুনরায় মোড়কজাত করে বিক্রি করা হচ্ছে রেয়াজউদ্দিন বাজারের পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে।

শুল্ক গোয়েন্দাদের লক করা কনসাইনমেন্ট নিলামের মাধ্যমে ছাড় করতে ব্যয় হচ্ছে  ৫২ লক্ষ ( শুল্কবাবত) টাকা। আমদানি করা এসব পণ্য মেয়াদ শেষ হবে চলতি মাসের ২৭ তারিখে। সুত্রমতে, সাবানের মেয়াদ শেষ হবার আগেই নিলামে বিক্রি করা হয়েছে কনটেইনারটি। কারণ মেয়াদ শেষ হবার পর কনটেইনার ভর্তি পণ্য ধংস করতে হবে। তবে চট্টগ্রাম কাস্টমস প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি করা হলে মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্যের কারনে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নেবার অনুরোধ জানিয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানায়। সেই চিঠিতে এই পণ্য মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নিলামে বিক্রি করার আদেশ চাওয়া হয়েছে ( ওবিপিসি ১/১০২৬/২০)। সল্প সময়ের মধ্যে প্রকাশ্য নিলাম না করে পণ্যের মেয়াদ শেষ হবার আগেই গোপনে নিলাম করা হয়েছে সাবানের চালানটি। নথি অনুযায়ী : এমন অনৈতিক প্রস্তাবে জরুরি ভিত্তিতে সম্মতি দিয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা এনামুল হক, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান এবং জানিবুল হক।

সুত্রমতে, আমদানিকারকই সেসব পন্য নিলামে ক্রয় করে নিজের গুদামে নিয়ে পুনরায় মোড়কজাত করে বাজারে ছাড়বে। সংশ্লিষ্ট সুত্রমতে, পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ ফেব্রুয়ারী কনটেইনার নিলাম শেড থেকে বের করা হবে। সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্যগুলো কেনই বা তড়িঘড়ি করে নিলামের মাধ্যমে ৫৪ লক্ষ টাকা খরচ করে বের করা হচ্ছে। সুত্রমতে, প্রকৃতপক্ষে এই কনটেইনারের শুল্ক পরিশোধ করতে হবে দুই কোটি টাকার উপরে। মোড়ক পরিবর্তন করে বাজারে ছেড়ে মুনাফা লাভের আশার এমন কারসাজি করা হয়েছে – জানিয়েছে একাধিক সুত্র।

মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই কনটিনারটি নিলামে বিক্রি করার কথা স্বীকার করে কাস্টমসের নিলাম শাখার কর্মকর্তা নুরুন নবী বলেন, ‘২০১৫/১৮ সালের আমদানি নীতিমালা অনুসরণ করে এই কনটেইনার নিলাম করা হয়েছে । পণ্যের মেয়াদ শেষ হবার আগেই নিলাম করা হয়েছে। মেয়াদ শেষ হলে বা কনটেইনার ছাড় না হলে, আনন্দবাজার এলাকার ধ্বংস কেন্দ্রে নিয়ে যাব।’

সরেজমিনে গিয়ে আগ্রাবাদের ডিটি রোড়ে আমদানিকারকের ঠিকানায় গিয়ে টিএইচ এন্টারপ্রাইজ নামের কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মেলেনি। সুত্রমতে, ভুয়া ঠিকানায় আমদানি করা এসব পণ্য উচ্চমুল্যে বাজারে ছাড়ার কৌশল হিসেবে ( কম শুল্কে) নিলাম থেকে মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পনের দিন আগে ক্রয় করেছেন আমদানিকারক। নতুন করে ছাপানো মোড়ক ব্যবহার করে বাজারজাত করা হবে একই প্রিমিয়াম সাবান।একটি সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানের জমা বিল অব লান্ডিং অনুসারে মাত্র ১৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা শুল্কায়ন করা হয়। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দারা কনটেইনারের কায়িক পরীক্ষা করে পন্যের পরিমান ও শুল্কের পরিমানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্যের তথ্য পাবার পর সে কনটেইনারে দুইটি লক করেন ; এরপর থেকে বন্দরেই পড়ে ছিলো সেই কনটেইনার ।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘ নিলামযোগ্য পণ্য যাচাই বাছাই করে নিলাম শেডে রাখা হয়৷ সেখান থেকে আমদানিকারকরা নিলামে এসব মেয়াদবিহীন পণ্য কিনে বাজারে ছেড়ে থাকলে সেটি দেখার দায়িত্ব সরকারী সংস্থার। ‘

ইয়ার্ডের ভেতরে জায়গা বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই কনটেইনারবাহী গাড়িগুলো সহজে মুভমেন্ট করতে পারবে এবং কনটেইনার রাখার জায়গাও বাড়বে বলে মনে করেন চিটাগাং চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, এর সুফল পাবেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। কিন্তু মেয়াদ উর্ত্তীন্ন পণ্য নিলামে কিনে কোন অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে ছাড়লে প্রকৃত আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন ফাঁদ পেতে শুল্ক ফাঁকির কারসাজি হলে সেটি দেখার দায়িত্ব বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। ‘