কাস্টমস কমিশনারের আচরনে ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা
আবারও কার্গো খালাস বন্ধ রেখে’ ইউ ব্যাগেজ ‘ বাণিজ্য

::: নিজস্ব প্রতিবেদক :::

বিপুল সংখ্যক প্রবাসী  ও তরুণ জনগোষ্ঠী, উচ্চমাত্রায় অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা, ডিজিটাল ব্যবস্থায় অগ্রগতি, বেসরকারি খাতের দ্রুততর বিকাশ—এসবের বদৌলতে একের পর এক অর্থনৈতিক সফলতা পাচ্ছে বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে, দেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় মূল চালিকা শক্তি হবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স । কিন্তু সেই রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই চট্টগ্রাম কাস্টমসের যাঁতাকলে পড়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন । প্রবাসীদের আনা কার্গো খালাস বন্ধ রাখা হয়েছে অন্তত আটমাস ধরে। মাঝে একমাস চালু করলেও পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে কাস্টমসের সেই চক্র। পুনরায় চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে কার্গো খালাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

চলতি অর্থ বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সৌদি প্রবাসীরা দেশে প্রায় ৩.৪ (তিন দশমিক চার) বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন। তবে সৌদি আরবে বসবাসরত ২৮ লক্ষ সৌদি প্রবাসী বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণ করলে তা আরও অনেকাংশে বৃদ্ধি পেতে পারে এমন বিশ্লেষণ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের। কিন্তু দেশে ফিরে নিজের পন্য খালাস নিতে না পেরে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া প্রবাসীরা দুষছেন কাস্টমস হাউজের দুষ্ট চক্রকে। গত ২ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ কোন লিখিত ঘোষণা ছাড়াই কার্গো খালাস বন্ধ করে দিয়েছে।

জানা গেছে,  চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে দীর্ঘ ছয় মাসের বেশি সময় কার্গো খালাস বন্ধ রেখে জাহাজে আসা ‘ইউ ব্যাগেজ’ সুবিধার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের কোটি কোটি লোপাট করছে একটি চক্র। টিআর সুবিধার অপব্যবহার করে জাহাজে করে আনা হচ্ছে বাণিজ্যিক পণ্য। ‘ইউ ব্যাগেজ’ প্রক্রিয়া জনপ্রিয় করতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রবাসীদের ব্যাগেজ সুবিধায় আনা কার্গো খালাস। শুধু তাই নয় ইউ ব্যাগেজকে একচেটিয়া সুবিধা দিতে কার্গো বিমানের ফ্লাইটও বন্ধ রাখা হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রমজান এবং ঈদকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠালেও কাস্টম খালাস করায় প্রবাসীরা সেগুলো খালাস নিতে পারেনি । এর ফলে গত মার্চ পর্যন্ত বিমানবন্দরের কার্গো হলে জমে আছে অন্তত ৯০টি চালান। এতে পণ্য আছে প্রায় ২৫ মেট্রিক টন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের চাঞ্চল্যকর ঘুষ বাণিজ্যের তথ্য। সাধারণত দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশেগুলোতে বসবাস করা প্রবাসীরা দেশে আসার সময় প্রয়োজনীয় শুল্ক পরিশোধ করে কার্গো করে পারিবারিক ব্যবহারের পণ্য নিয়ে আসতো। একই সুবিধা জাহাজেও প্রচলিত ছিলো, তবে সেটি ততোটা পরিচিত ছিলো না। জাহাজে করে ইউ ব্যাগেজে জনপ্রতি একহাজার কেজি পণ্য বুকিং করা সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার বুকিং করা পণ্য দেশে আসতে এয়ার কার্গোর চেয়ে তিনগুন বেশি সময় লাগে।

প্রবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়,দীর্ঘ ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে এয়ার কার্গো ফ্লাইট ও কার্গো খালাস বন্ধ থাকার কারণে বাধ্য হয়েই ইউব্যাগেজ ব্যবসায়ীদের দারস্থ হতে হচ্ছে৷ সেই ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের পাসপোর্ট ব্যবহার করে অতিরিক্ত স্পসে বানিজ্যিক পণ্য বুকিং করছেন। ফলে ইউব্যাগেজে করে বানিজ্যিক শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই দেশের বাজারে ডুকছে গুঁড়ো দুধসহ উচ্চশুল্কের পণ্য।

মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী সামসুল জানান, এয়ার কার্গো করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা জনপ্রতি একশো থেকে তিনশো কেজি পর্যন্ত পন্য দেশে নিয়ে আসতো। কিন্তু ইউব্যাগেজে বুকিং করার মতো এতবেশি পণ্য (এক হাজার কেজি) তাদের থাকে না। ‘

আরেক প্রবাসী খোরশেদ আলম বলেন, প্রবাসীদের নিয়ে আসা প্রায় পঁচিশ হাজার কেজি কার্গো পণ্য চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আটকে দেবার কারনে সবাই ইউব্যাগেজ চক্রের ফাঁদে বন্দী। বিদেশ থেকে আত্নীয় স্বজনের জন্য পণ্য এনে বিপদে পড়েছি।  ‘

আবুল হাসেম নামের মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীও একই সুরে অভিযোগ করলেন। তিনি বলেন, সময় বেশি লাগলেও তুলনামূলক কম খরচে ইউব্যাগেজে পণ্য আনা যায়। প্রবাসী যাত্রীদের পাসপোর্টের বিপরীতে ব্যবহৃত স্পেসের অতিরিক্ত অংশ (১/৩ কেজি) করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন পণ্য এজেন্টরা অনায়াসে দেশে ডুকাচ্ছেন। এয়ারকার্গো বন্ধ করে রাখলে চোরাচালানের সাথে জড়িতদের সুবিধা। ‘

সুত্রমতে, চট্টগ্রাম বন্দরের তিন নং জেটিতে খালাস করা হয় জাহাজে করে আনা ইউ ব্যাগেজের পণ্য। প্রতি কনসাইনমেন্ট পণ্যের বিপরীতে তিন লক্ষ টাকা ঘুষ লেনদেনের কথা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইট বন্ধ রাখার পাশাপাশি প্রবাসীদের আনা পণ্য খালাসও বন্ধ করে সুবিধাজনক ইউব্যাগেজ বানিজ্য করছেন চট্টগ্রাম কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তা।

কাস্টমস কার্যালয়ের তথ্যমতে, কার্গো বিমান কিংবা জাহাজের ইউ ব্যাগেজে করে প্রবাসীদের আনা পন্যের শুল্ক সমান। যেহেতু প্রবাসীদের নিজস্ব পন্য এক হাজার কেজি হয় না। সেকারণে কার্গো বিমানে করে পণ্য আনা প্রবাসীদের কাছে জনপ্রিয়। তবে সেই সুবিধার অবৈধ ব্যবহারও কম নয়।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন,  মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পণ্যবাহী কার্গো বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বাংলাদেশ বিমান, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমসের আয় কমেছে। গত কয়েক মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় কম হয়েছে বলে দুটি বিদেশি বিমান সংস্থার সূত্রে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম বিমানবন্দর সূত্রমতে, প্রতি সপ্তাহে দুটি কার্গো ফ্লাইটে করে দুটি বিমান সংস্থার পণ্যবাহী উড়োজাহাজ চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর রুটে পণ্য পরিবহন করে আসছিল। গত বছরের অক্টোবর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বসবাসরত প্রবাসীদের আনা কার্গো মালামাল ছাড় করা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ কারণে গত বছরের অক্টোবর থেকে চট্টগ্রামে আসেনি কোন কার্গো বিমান।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে কার্গো পন্য খালাস বন্ধ রাখার কারনে সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন।

সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান মেসার্স মনির আহমেদ’র কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফ বলেন, বিমানবন্দর কেন্দ্রিক সিএন্ডএফ মালিকদের অনেকেই ব্যবসার লোকসান সইতে না পেরে ব্যবসা পরিবর্তন করেছেন। বিমানবন্দর থেকে ভাড়া নেয়া কার্যালয়ের ভাড়া পরিশোধ করতে না পারার কারণে বেশ কয়েকজন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী অফিস ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

মেসার্স এক্সিলেন্ট লিমিটেডের পরিচালক নাসির আহমেদ জানান, ব্যবসায়িক মন্দা ও বেতন পরিশোধ করতে না পারার কারনে সিএন্ডএফ কর্মচারীরাও বিমানবন্দরে কাজ করতে রাজি হচ্ছেন না। পণ্য খালাস বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে গেছে কার্গো উঠানামায় নিয়োজিত প্রায় শতাধিক শ্রমিক। বিমানবন্দর এখন পর্যন্ত বিশ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। ‘

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশেন অর্গানাইজেশন বিমানবন্দরের সক্ষমতা নিরুপণ করে প্রতিবেদন দেয়। বিমানবন্দরের সক্ষমতার বড় একটি অংশ কার্গো পরিবহন, কার্গো ওয়্যারহাউসের সক্ষমতা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কার্গো খালাস বন্ধ থাকায় এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।কার্গো ফ্লাইট ও পণ্যখালাস বন্ধ থাকার কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে শাহ আমানত বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। একইসাথে বিলম্ব মাসুলবাবদ যুক্ত হবার কারণে অনেকেই নিজেদের পণ্য ছাড়িয়ে নিতে অনীহা প্রকাশ করছে। শুধু গেল বছরের ডিসেম্বরে ওয়্যারহাউসের বিলম্ব মাসুলবাবদ বিমানবন্দরে আয় হয়েছিলো ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য মতে, ইমপোর্ট কার্গো থেকে ২০২২ সালের জুনে বিমানবন্দর কার্গো ওয়্যার হাউস থেকে ২৫,৫৪,৬৭৩ টাকা আয় হয়েছে । একই বছরের জুলাই মাসে ৩২,২২,৩৪২ টাকা, আগস্টে ২৯,৭৭,৭৬২ টাকা, সেপ্টেম্বরে ২১,৪৭,০৮৪ টাকা, অক্টোবরে ৯,৮৪,২৭১ টাকা, নভেম্বরে ১০,০৮,০৬৭ টাকা আয় হয়। বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখার পর ডিসেম্বর মাসে গণমাধ্যমে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার কারনে পণ্য খালাস চালু করা হলে শুধু ডিসেম্বরেই ১,৪৪,৩৫,৬৪৪ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।আর কার্গো খালাস বন্ধ থাকার কারণে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে আয় নেমে আসে চার লাখ টাকায়। চলতি বছরের মার্চ মাসে আয় হয়েছে মাত্র ৪০ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্টদের, মতে প্রতি সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে দুটি কার্গো ফ্লাইট আসতো ; তাও বন্ধ হয়। ফলে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ফ্লাইট উঠানামা বাবত যে রাজস্ব পেতো সেটিও বন্ধ। অযাচিতভাবে কার্গো খালাস বন্ধ করে রাখার কূটকৌশলে অন্তত বিশ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে শাহ আমানত বিমানবন্দর।

যদিও চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার ফয়জুর রহমানের যুক্তি ব্যাগেজে নিয়ে আসা অবৈধ পন্য ঠেকানোর জন্য কার্গো খালাস বন্ধ করে রাখা হয়েছে। জনপ্রতি এক শত কেজির বেশি পণ্যের কনসাইনমেন্ট আটকে রাখা হয়েছে।

কিন্তু কার্গো খালাসের অপেক্ষায় থাকা নথি পর্যালেচনা করে দেখা যায় একশ কেজির একটি কনসাইনমেন্ট আটকে দেয়া হয়। নিরীক্ষার বিশ হাজার টাকা শুল্ক দাবি করেছে। অথচ ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী ৬৫ কেজি পণ্য প্রবাসীরা বিনা শুল্কেই আনতে পারেন। বাকী ৩৫ কেজি পণ্যে কোন যুক্তিতে বিশ হাজার টাকা শুল্কায়ন করা হয়েছে সেই উত্তর দিতে পারেন নি কাস্টমস কর্মকর্তাদের কেউ।

এনবিআরের নীতিমালা পর্যালোচনা করে দেখা যায় একজন প্যাসেঞ্জার কতটুকু পর্যন্ত পন্য আনতে পারবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন সীমারেখা নেই। কিন্তু একশ কেজির সীমারেখাটি নির্ধারণ করেছেন কাস্টমস কমিশনার নিজেই। জানতে চাইলে তিনি প্রতি প্রবাসী ইউ ব্যাগেজে কিভাবে এক হাজার কেজি পণ্য আনতে পারে, সেটি কেন বন্ধ করা হয় নি- এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন নি। কাস্টমস হাউজের কোন কর্মকর্তাই ‘ইউ ব্যাগেজ ‘ সুবিধা ব্যবহার করে বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি সিন্ডিকেটের বিষয়ে কোন কিছু জানাতে রাজি হন নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারে কসমেটিকস, গুঁড়ো দুধ, পারফিউম, বিদেশি সিগারেটের আশি শতাংশই ডুকছে ‘ইউ ব্যাগেজ’ পদ্ধতিতে। প্রবাসী যাত্রীদের নামে জাহাজে বুকিং করা হলেও ব্যাগেজের আশি শতাংশ জায়গা ব্যবহৃত হচ্ছে শুল্ক ফাঁকি দেবার পণ্যে। রেয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে অনেকে বিদেশ থেকে আসার সময় কিছু ব্যবহার্য পণ্য আনতো। সেসব পণ্যের একটি অংশ রেয়াজউদ্দিন বাজারের পাইকারি দোকানে বিক্রিও করা হতো। কিন্তু বর্তমানে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারাই বিনিয়োগ করে প্রবাস থেকে যাত্রীদের সাথে ইউব্যাগেজ বুকিং করাচ্ছে। শতাধিক লাগেজ ব্যবসায়ী এখন নিজেদের পণ্য আনছেন প্রবাসীদের ব্যবহার করে। ‘

রাউজান এলাকার ল্যাগেজ ব্যবসায়ী জাহেদ ( ছদ্মনাম) জানান, ‘ নিরবে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বিদেশি পণ্যের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। জাহাজে করেই এখন এখন পণ্য ডুকে। কারণে এয়ার কার্গোতে গড়পড়তা খরচ বেশি, জনপ্রতি পণ্যও বেশি আনা যায় না। বিমানবন্দরে চেকিং এর মুখোমুখি হতে হয়, সে কারণে ইউব্যাগেজে ঝামেলামুক্ত পণ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছে। ‘

এয়ারকার্গো বন্ধ থাকার জন্য তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরাই কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বিমানবন্দর দিয়ে আসা পণ্য খালাস বন্ধ রেখেছে৷ কারন বিমানবন্দর দিয়ে জেনুইন যাত্রীরা কার্গো করে পণ্য আনার সুযোগ পেলে ইউব্যাগেজ বুকিং এবং ছাড় করার জন্য প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট মিলবে না। ‘

দেশের অর্থনীতির দূরাবস্থার মধ্যে স্বস্তি কিছুটা  ফিরিয়েছে প্রবাসীরা। রেমিট্যান্স প্রবাহের দেশের অর্থনীতি বাঁচালেও দেশে ফিরে নিজেরাই চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের অসাধু কর্মকর্তাদের যাঁতাকলে পড়েছেন।

মেসার্স এক্সিলেন্ট লিমিটেডের পরিচালক নাসির আহমেদ জানান, ব্যবসায়িক মন্দা ও বেতন পরিশোধ করতে না পারার কারনে সিএন্ডএফ কর্মচারীরাও বিমানবন্দরে কাজ করতে রাজি হচ্ছেন না। পণ্য খালাস বন্ধ থাকায় বেকার হয়ে গেছে কার্গো উঠানামায় নিয়োজিত প্রায় শতাধিক শ্রমিক। বিমানবন্দর এখন পর্যন্ত বিশ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। ‘

সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পণ্য খালাস নিতে না পারায় প্রতিদিন বাড়ছে বিমানবন্দরের ওয়্যারহাউস চার্জ। কার্গো হলে নষ্ট হচ্ছে প্রবাসীদের আনা পণ্য। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশেন অর্গানাইজেশন বিমানবন্দরের সক্ষমতা নিরুপণ করে প্রতিবেদন দেয়। বিমানবন্দরের সক্ষমতার বড় একটি অংশ কার্গো পরিবহন, কার্গো ওয়্যারহাউসের সক্ষমতা। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কার্গো খালাস বন্ধ থাকায় এভিয়েশন সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

কার্গো ফ্লাইট ও পণ্যখালাস বন্ধ থাকার কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে শাহ আমানত বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। একইসাথে বিলম্ব মাসুলবাবদ যুক্ত হবার কারণে অনেকেই নিজেদের পণ্য ছাড়িয়ে নিতে অনীহা প্রকাশ করছে। শুধু গেল বছরের ডিসেম্বরে ওয়্যারহাউসের বিলম্ব মাসুলবাবদ বিমানবন্দরে আয় হয়েছিলো ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তথ্য মতে, ইমপোর্ট কার্গো থেকে ২০২২ সালের জুনে বিমানবন্দর কার্গো ওয়্যার হাউস থেকে ২৫,৫৪,৬৭৩ টাকা আয় হয়েছে । একই বছরের জুলাই মাসে ৩২,২২,৩৪২ টাকা, আগস্টে ২৯,৭৭,৭৬২ টাকা, সেপ্টেম্বরে ২১,৪৭,০৮৪ টাকা, অক্টোবরে ৯,৮৪,২৭১ টাকা, নভেম্বরে ১০,০৮,০৬৭ টাকা আয় হয়। বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখার পর ডিসেম্বর মাসে গণমাধ্যমে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার কারনে পণ্য খালাস চালু করা হলে শুধু ডিসেম্বরেই ১,৪৪,৩৫,৬৪৪ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।আর কার্গো খালাস বন্ধ থাকার কারণে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে আয় নেমে আসে চার লাখ টাকায়। চলতি বছরের মার্চ মাসে আয় হয়েছে মাত্র ৪০ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্টদের, মতে প্রতি সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে দুটি কার্গো ফ্লাইট আসতো ; তাও বন্ধ হয়। ফলে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ফ্লাইট উঠানামা বাবত যে রাজস্ব পেতো সেটিও বন্ধ। অযাচিতভাবে কার্গো খালাস বন্ধ করে রাখার কূটকৌশলে অন্তত বিশ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে শাহ আমানত বিমানবন্দর।

যদিও চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার ফয়জুর রহমানের যুক্তি ব্যাগেজে নিয়ে আসা অবৈধ পন্য ঠেকানোর জন্য কার্গো খালাস বন্ধ করে রাখা হয়েছে। জনপ্রতি এক শত কেজির বেশি পণ্যের কনসাইনমেন্ট আটকে রাখা হয়েছে।

কিন্তু কার্গো খালাসের অপেক্ষায় থাকা নথি পর্যালেচনা করে দেখা যায় একশ কেজির একটি কনসাইনমেন্ট আটকে দেয়া হয়। নিরীক্ষার বিশ হাজার টাকা শুল্ক দাবি করেছে। অথচ ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী ৬৫ কেজি পণ্য প্রবাসীরা বিনা শুল্কেই আনতে পারেন। বাকী ৩৫ কেজি পণ্যে কোন যুক্তিতে বিশ হাজার টাকা শুল্কায়ন করা হয়েছে সেই উত্তর দিতে পারেন নি কাস্টমস কর্মকর্তাদের কেউ।

এনবিআরের নীতিমালা পর্যালোচনা করে দেখা যায় একজন প্যাসেঞ্জার কতটুকু পর্যন্ত পন্য আনতে পারবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন সীমারেখা নেই। কিন্তু একশ কেজির সীমারেখাটি নির্ধারণ করেছেন কাস্টমস কমিশনার নিজেই। জানতে চাইলে তিনি প্রতি প্রবাসী ইউ ব্যাগেজে কিভাবে এক হাজার কেজি পণ্য আনতে পারে, সেটি কেন বন্ধ করা হয় নি- এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন নি। কাস্টমস হাউজের কোন কর্মকর্তাই ‘ইউ ব্যাগেজ ‘ সুবিধা ব্যবহার করে বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি সিন্ডিকেটের বিষয়ে কোন কিছু জানাতে রাজি হন নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারে কসমেটিকস, গুঁড়ো দুধ, পারফিউম, বিদেশি সিগারেটের আশি শতাংশই ডুকছে ‘ইউ ব্যাগেজ’ পদ্ধতিতে। প্রবাসী যাত্রীদের নামে জাহাজে বুকিং করা হলেও ব্যাগেজের আশি শতাংশ জায়গা ব্যবহৃত হচ্ছে শুল্ক ফাঁকি দেবার পণ্যে। রেয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে অনেকে বিদেশ থেকে আসার সময় কিছু ব্যবহার্য পণ্য আনতো। সেসব পণ্যের একটি অংশ রেয়াজউদ্দিন বাজারের পাইকারি দোকানে বিক্রিও করা হতো। কিন্তু বর্তমানে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারাই বিনিয়োগ করে প্রবাস থেকে যাত্রীদের সাথে ইউব্যাগেজ বুকিং করাচ্ছে। শতাধিক লাগেজ ব্যবসায়ী এখন নিজেদের পণ্য আনছেন প্রবাসীদের ব্যবহার করে। ‘

রাউজান এলাকার ল্যাগেজ ব্যবসায়ী জাহেদ ( ছদ্মনাম) জানান, ‘ নিরবে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বিদেশি পণ্যের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। জাহাজে করেই এখন এখন পণ্য ডুকে। কারণে এয়ার কার্গোতে গড়পড়তা খরচ বেশি, জনপ্রতি পণ্যও বেশি আনা যায় না। বিমানবন্দরে চেকিং এর মুখোমুখি হতে হয়, সে কারণে ইউব্যাগেজে ঝামেলামুক্ত পণ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছে। ‘

এয়ারকার্গো বন্ধ থাকার জন্য তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ল্যাগেজ ব্যবসায়ীরাই কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে বিমানবন্দর দিয়ে আসা পণ্য খালাস বন্ধ রেখেছে৷ কারন বিমানবন্দর দিয়ে জেনুইন যাত্রীরা কার্গো করে পণ্য আনার সুযোগ পেলে ইউব্যাগেজ বুকিং এবং ছাড় করার জন্য প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট মিলবে না। ‘

জানা গেছে শুধু চট্টগ্রাম বিমানবন্দর নয় রাজধানী ঢাকা, সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে কার্গো পণ্যের ল্যাগেজ ছাড় করা বন্ধ রাখা হয়েছে। কদাচিৎ অবৈধ পণ্য ধরা পড়ার যুক্তি ব্যবহার করে বিমানবন্দরে কার্গো খালাসে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে ছক অনুযায়ী। চোরাকারবারিদের জন্য সহজ রুট তৈরি করে দিয়েছে কাস্টমস হাউজের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা। কার্গো বন্ধ রাখার কারণে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু রাজস্ব হারালেও ; ইউব্যাগেজের নৌ রুটে কাস্টমস কর্মকর্তাদের পকেটে ডুকছে বছরে ডুকছে চোরাচালানের শত কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন কাস্টমস কমিশনারের বিমাতাসুলভ আচরনে সংক্ষুব্ধ প্রবাসীদের মাঝে বিরুপ মনোভাব তৈরি করতে পারে। প্রবাসীদের আনা পণ্য নিলামে বিক্রি করা হলো দাঁনা বাঁধতে পারে আন্দোলনও।