পাঁচ লাখ গ্রাহকের টাকা বিদেশে
অনলাইন ট্রেডিংএ প্রতারণার ফাঁদ এমটিএফই

নিজস্ব প্রতিবেদক :::

অনলাইন ট্রেডিংয়ের নামে দুবাই ও কানাডা ভিত্তিক  মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জে (এমটিএফই) বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন দেশের লাখো মানুষ। প্রতারণা করে বাংলাদেশিদের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। বায়বীয় কার্যক্রমের এই কোম্পানির ৪০০ সিইওর বিরুদ্ধে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করছেন গোয়েন্দারা। তাদের আটক বা গ্রেপ্তার করতে গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি সাইবার ফুটপ্রিন্ট সংগ্রহ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

রিয়েল মার্কেটের আদলে শেডো মার্কেট বানিয়ে গ্রাহকদের ফাঁদে ফেলে বানিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে এমটিএফই।এজন্য গ্রাহকদের অ্যাপসের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানো হয় এবং লেনদেন পরিচালনা করা হয়। প্রলোভন দেখানো হয় ৬ মাসে দ্বিগুন লাভ দেয়ার। গ্রাহকদের টাকা আফ্রিকার স্বর্ণের খনিসহ বিভিন্ন দেশে ইনভেস্ট করা হয়েছে বলে জানানো হয়।

এক্ষেত্রে প্রমাণ দেখাতে তারা বিভিন্ন ওয়েবসাইট ক্লোন করে প্রতারণা করে গেছে। বাস্তবে তারা কোথাও টাকা ইনভেস্ট করেনি। উল্টো এদেশে সিও ও এজেন্ট নিয়োগ দিয়ে সভা সেমিনার করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাপক হারে মানুষের মাঝে অ্যাপসটি ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠান সারা বাংলাদেশে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ও সিইও নিয়োগ দিয়েছিল। ইতিমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটির শতাধিক সিইওর (প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা) ভার্চুয়ালি অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সারা দেশে এই সিইওদের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ অল্প সময়ে অধিক মুনাফার লোভে পড়ে টাকা দিয়েছে। সিইওরা এই টাকায় ডলারের মাধ্যমে বিট কয়েন ক্রয় করে তাদের অ্যাকাউন্টগুলোতে ট্রান্সফার করে নেয়।

মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ ইনকরপোরেটেডে অনলাইন প্রতারণার বিষয়ে তথ্য চেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এমটিএফই নামের একটি মুঠোফোন অ্যাপে বিনিয়োগ করে চলতি বছরে বাংলাদেশের বহু মানুষ প্রতারিত হয়েছেন। রীতিমতো প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এমটিএফই। এমন প্রেক্ষাপটে শুক্রবার সিআইডি গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে এমটিএফইর প্রতারণার বিষয়ে তথ্য চেয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানা যায় এমটিএফই বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০২১ সালে। তিন বছরে এমটিএফইতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই ৪২ লাখ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়েছে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে দেশের ২৬ টি জেলা শহরে। প্রাথমিক অবস্থায় এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। এমটিএফইর অনলাইন প্রতারণায় ঢাকা, বরিশাল, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং সাতক্ষীরায় সবচেয়ে বেশি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটি বলছে, ভার্চুয়াল দুনিয়ার ডলার, শেয়ার বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচার এই প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশে চার থেকে পাঁচ লাখ গ্রাহকের মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

স্মার্ট ও কৌশলী তরুন তরুনীদের সিইও বানিয়ে অর্জন করা হয়েছে গ্রাহকদের আস্থা। কোন কোন জেলায় চিকিৎসক, চাকুরীজীবি, মেরিনার, বিদেশ প্রবাসীদের কাজে লাগিয়ে গ্রাহকদের কাছে আস্থা অর্জন করেছে ‘এমটিএফই’। ভার্চুয়াল দুনিয়ার ডলার, শেয়ার বা ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচার কথা বলে ফাঁদে ফেলা হয়েছে বেকার যুবকদের। পেশাদার আচরনের কারণে বেশি টাকা আয় করার লোভে অনেকেই ৫ হাজার ডলারের বেশিও বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে কেউ জমানো টাকা, কেউবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবার কেউ জমি বন্ধক রেখে বিনিয়োগ করেছিলেন।

চট্টগ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ গ্রাহক নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, তানভীর আহমেদ ইমন নামের এক তরুনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ফাঁদে পা দেন তারা। পেশায় একজন মেরিনার, থাকেনও বিদেশে। একারণে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে এমটিএফই’র সাথে যুক্ত করে নেন তানভীর ইমন। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে নেটওয়ার্কিং সেশন করে লোভ দেখানো হয়েছে বৈধ পথে লাখ টাকা উপার্জনের। জুমে সংযুক্ত হয়ে এমটিএফই’র কর্মকর্তা কথা বলতেন গ্রাহকদের সাথে।

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার সাউথ ল্যান্ড সেন্টারে একটি অনলাইন শপের আড়ালে ‘এমটিএফই’ র বিস্তার ঘটে পুরো নগরীতে। ফরেক্স ব্যবসায় বিনিয়োগের কথা বলে পরিচিত জনকে কাছে টেনেছেন জিয়া নামের আরেক তরুন। এছাড়া,  ইফকো কমপ্লেক্স কেন্দ্রিক এক যুবলীগ নেতার কথা বলছেন ভুক্তভোগীরা। সুত্রমতে,  চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের ডাকসাইটে এই নেতা লন্ডনে বেশ কিছু টাকা দেশ থেকে সরাতে গিয়ে এমএফটিই’র প্রতারণার শিকার হন। বড় অংকের এই টাকা খোয়ানোর পরে এমএফটিই থেকে সরে যান তিনি।

গ্রাহকদের ঢাকার উত্তরা ১১ নং সেক্টরে নিজের সুজ্জিত অফিসে ডেকে নিয়ে শাহরুক হোসাইন  নামের আরেক যুবক এমটিএফই  ফাঁদে ফেলেন। শাহরুখ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ ব্যাচের ছাত্র। তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। তবে চট্টগ্রামে বেশ কিছু বসবাস করেছেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী তার ফাঁদে পা দিলেও মুখ খুলতে নারাজ কেউ। গ্রাহকরা কাউসার আহমেদ নামের আরেক হোটেল ব্যবসায়ীর কথা বলছেন। চট্টগ্রামের গরীব উল্লাহ মাজার এলাকায় কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গেস্ট হাউজে বসে এমটিএফই’র কার্যক্রম চালাতেন কাউসার। ভুক্তভোগীরা বলেন  নিজের বিশাল ব্যবসা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সখ্যতা পুঁজি করে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছেন কাউসার।

জানা যায়,  গত ৭ আগস্ট সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে এমটিএফই।এরপর গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) রাতে হুট করে প্রায় সব গ্রাহকের ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে অ্যাপটি। তবে, সুত্রমতে আগস্ট মাসে ব্যবসা গুটিয়ে নেবার পরিকল্পনা ছিলো তাদের। অনেক গ্রাহকদের টাকা সরিয়ে নেবার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

তবে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। এজন্য উল্টো গ্রাহকদের কাছ থেকেই তারা টাকা পাবে। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করা গ্রাহকরা লাভের গুড় তো পায়নি বরং তাদের ঘাড়ে আরও ঋণের বোঝা চেপেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, এমটিএফই’র প্রতারণা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও তথ্য পেলেও এখনও লিখিত কোনো অভিযোগ কিংবা মামলা হয়নি। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা আইনী হয়রানীর আশংকায় কোন অভিযোগই করতে রাজি নয়।  তবে মামলা না পেলেও এ বিষয়ে ছায়াতদন্ত চলছে।

সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, বাংলাদেশে এমটিএফই’র যারা পরিবেশক বা প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া কেউ যদি অভিযোগ দেন, সে বিষয়েও আমরা ব্যবস্থা নেব। এমটিএফই একটি ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম চক্র। তাদের কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ বায়বীয়।’

অনুসন্ধানে  কুমিল্লা শহরে এমটিএফই’র এলিন নামের এক যুবকের নাম জানা গেছে গ্রাহকদের কাছে। জনি নামের আরেক চিকিৎসকও জড়িত ‘এমটিএফই’ বিস্তারের নেটওয়ার্কে। ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা এই যুবক চিকিৎসা সেবায় যুক্ত থাকার সুনামকে পুঁজি করে এমটিএফই’র বিস্তার ঘটিয়েছেন শহরে।