৩৩৮ থানার ওসি বদলি
তিনশো কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য

বিশেষ প্রতিনিধি :::

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৩টি থানাসহ সারাদেশের ৩৩৮টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বদলি করার পর আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে । বিশেষ করে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান নি, মাঠ পর্যায়ে কর্মরত এমন ওসিদের ( তদন্ত,অপারেশন) ক্ষোভ বেড়েছে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অনুমোদনে পর ওসিদের বদলি করা হলেও জেলার ভেতরে ইন্টারচেন্জের কারণে নির্বাচনী পরিবেশে কোন পরিবতন আনা যাবে না – এমন বিশ্লেষণ বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, নির্বাচনী পদায়নে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তুলনায় ওসি তদন্ত কিংবা ওসি অপারেশন পদের কর্মকর্তারা একই ব্যাচ কিংবা একই গ্রেডের হয়েও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন ।

বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে ওসিদের বদলির বিষয়টি জানানোর পর ক্ষোভ বেড়েছে নন ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাদেরও। এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশের ৩৩৮ থানার ওসি ও ১৫৮ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বদলির প্রস্তাব অনুমোদন দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

গত ৩০ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে যেসব থানার ওসিদের বর্তমান কর্মস্থলে ছয় মাসের বেশি চাকরির মেয়াদ হয়েছে, তাদের অন্যত্র বদলি করতে চিঠি দিয়েছিল ইসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার ৩৩৮ থানার ওসির বদলির প্রস্তাব পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর ওসি বদলির অনুমোদন দেয় নির্বাচন কমিশন। বদলি হওয়া ঢাকা মেট্রোপলিটনের ওসিরা থেকে গেলেন ঢাকাতেই, ব্যতিক্রম হয় নি সিএমপিতেও। বদলিকৃতদের মধ্যে ডিএমপির ৩৪ জন ওসি রয়েছেন। তালিকায় দেখা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০ থানার মধ্যে যে ৩৪ জন ওসিকে বদলি করা হয়েছে তাদের ঢাকাতেই বিভিন্ন থানার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

পুলিশের সুত্রমতে, পছন্দের থানা পেতে সপ্তাহ ধরে দৌড়ঝাঁপ করেছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি)। নির্বাচন কমিশন (ইসি) বদলির নির্দেশ দেওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দেন ।নির্বাচনের এক মাস আগে সারাদেশে ওসি বদলিতে ঘুষ বাণিজ্য হয়েছে অন্তত তিনশো কোটি টাকা। সর্বনিম্ন পঞ্চাশ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হয়েছে প্রতিটি ওসির বিপরীতে। শুধু চট্টগ্রামের একটি থানায় ওসি বদলিতে দুই কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে দাবি সুত্রটির।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে দেশের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প অবস্থিত যেখানে শতাধিক বিদেশি শ্রমিক -কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছে৷ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার অজুহাতে সীতাকুণ্ডের বিতর্কিত ওসি তোফায়েল আহমেদকে বাঁশখালী থানায় পদায়ন সুবৃহৎ এই প্রকল্পের নিরাপত্তা ও পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, এমন অভিযোগ পৌঁছে গেছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের টেবিলে। দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ আবুল খায়ের গ্রুপের ক্রাপবাহী ড্রামট্রাক সুপরিকল্পিতভাবে ডাকাতির অভিযোগ উঠা ওসি তোফায়েল আহমেদের পদায়ন করা হয়েছে বাঁশখালী থানায়।

ওসি তোফায়েল তার বর্তমান কর্মক্ষেত্রে
১৯৬ কারখানায় চাঁদাবাজি করে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে এমন সংবাদ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হবার পরদিনই তাকে বাঁশখালীতে পদায়ন করা হয়। অথচ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানা এলাকার ১৯৬ কারখানা থেকে মাসে দেড় কোটি টাকা ‘চাঁদাবাজি’ র অভিযোগ উঠা সেই ওসি তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।

অভিযোগপত্র অনুসারে , সীতাকুণ্ডের ১৯৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, চোরাই জ্বালানি তেল ও জাহাজের পুরোনো আসবাব বিক্রির দোকান, ড্রামের কারখানা, পুরোনো লোহা বিক্রেতা, পরিবহন চালক—কেউই বাদ যান নি চাঁদাবাজি থেকে। পুলিশ সদর দপ্তর ওসি তোফায়েলের বিরুদ্ধে যেদিন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সেদিনই তাকে আরেকটি থানায় প্রাইস পোস্টিং দেয়া হয়েছে,যেখানে দেশের অন্যতম বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প অবস্থিত।

পুলিশের ঘনিষ্ঠ একটি সুত্র জানায়, সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নতুন নয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শিপইয়ার্ডে মো. রাসেল নামে এক শ্রমিককে হত্যার পর মরদেহ গুম করার অভিযোগ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। মরদেহ গুমের অভিযোগ এনে আদালতে মামলার জন্য আবেদন করেন ভুক্তভোগী শ্রমিকের বাবা মো. ইউনুস মিয়া। চলতি বছরের ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদুল হকের আদালতে সীতাকুণ্ডের ওসি তোফায়েলসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করে ভুক্তভোগী শ্রমিকের বাবা। চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার শফিউল্লাহর সাথে খুলনা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় কাজ করেছেন তিনি। সেই সুবাধে সীতাকুণ্ড থানায় ঘুষের স্বেচ্ছাচারিতা সংবাদের শিরোনাম হলেও বহাল তবিয়তে থেকেছেন থানার চেয়ারে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কর্মরত এক সংবাদকর্মী জানান, থানায় যোগদানের পর হতে তোফায়েল আহমেদ একই থানার মহিলা মুন্সি কনস্টেবল নাসরীনকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন সময় ধর্ষন করে আসছিলেন। এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরে পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ সেই মহিলা মুন্সীকে অন্যত্র বদলি করে দিলেও নিশ্চিন্ত থেকেছেন তোফায়েল ।

জানা যায়, তোফায়েল আহমেদ ওসি ডিবি হিসেবে খুলনায় কর্মরত থাকা অবস্থায় জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা ধরনের অপকর্ম জড়ান তিনি ।

আরেকটি সুত্রের দাবি, জেলার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ হবার কারনে ওসি তোফায়েল সীতাকুণ্ডের সার্কেল অফিসারকেও নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করেছেন। তার ভয়ে অধিনস্থ পুলিশ কর্মকতারাও তটস্থ থাকেন। জেলার শীর্ষকর্তার ঘনিষ্ঠ হবার কারণে সীতাকুণ্ড থানায় যোগদানের পর থেকে তিনি চট্টগ্রাম জেলার ওসিদের বদলির তদবির বানিজ্য করে আসছেন; সুত্রটির দাবি।

সীতাকুণ্ড থানার একটি সুত্রমতে, ওসি তোফায়েল এতটা নারী লিপ্সু যে শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘কেএসআরএম গ্রুপ’ হতে সীতাকুণ্ড থানার ইন্টেরিয়রের কাজ দেখবাল করার জন্য একজন সুন্দরী নারী থানায় আসলে তিনি ওই নারীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে অনৈতিক মেলামেশা করতে বাধ্য করেন। বিষয়টি জানাজানি হবার পর লাখ টাকায় চাপা দেয়া হয়েছে সেই সংবাদ।

তোফায়েল আহমেদ সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ড ব্যবসায়ী ইকবালকে নিয়ে প্রায় সময় নারী জুয়া মদ নিয়ে আড্ডা মজে থাকেন, এমন তথ্যও মিলেছে অনুসন্ধানে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার কাছে পুলিশিং এর চেয়ে নেশার প্রাধান্য বেশি। তিনি প্রায় সময় নেশায় বুঁদ থাকেন।

সুত্রমতে, তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার আইজিসেলে অর্ধ শতাধিক পৃষ্ঠা সম্বলিত অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। যার প্রেক্ষিতে গত ৬ এবং ৭ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে, তদন্ত কমিটি তদন্ত কার্যক্রম শুরুর আগেই বাঁশখালীর মতো থানায় বদলি করে পুরস্কৃত করা হয়েছে তাকে।

এদিকে, নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে নির্বাচনের কমিশনের ওসি ও ইউএনও বদলির সিদ্ধান্তকে আইওয়াশ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে নির্বাচনে মূল দায়িত্ব পালন করা ডিসি ( রিটার্নিং কর্মকর্তা) ও এসপিদের বদল না করে ইউএনও ও ওসিদের বদল করার সিদ্ধান্ত লোক দেখানো ছাড়া কিছুই না। তাদের মতে, ওসিদের ‘ইন্টারচেঞ্জ’এর সিদ্ধান্ত নির্বাচনকে সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।

বিভিন্ন থানায় কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা একটি থানার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও দেশের বিভিন্ন থানায় কর্মরত ওসি তদন্ত কিংবা ওসি অপারেশন মাঠ পরিস্থিতির সাথে বেশি মাত্রায় সংশ্লিষ্ট। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামো ও অপারেশনাল কার্যক্রম শক্তিশালী করতে নির্বাচনের সময় তাদেরকে বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন করা হলে সুষ্ঠু ও নিরেপক্ষতার মাপকাঠিতে নির্বাচন কমিশনের উদ্দ্যেগ কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য হতো।

সরকারি বিধি অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তা একই পদে ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় কর্মরত থাকলে তার গ্রেড পরিবর্তন হবে। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে সাধারণত সেটা হয় না। জানা যায় পরিদর্শক থেকে এএসপি হিসেবে পদোন্নতির জন্য ৩৩ ভাগ কোটা থাকলেও গত তিন বছরে মাত্র ৩০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক সার্কুলারে সরাসরি এএসপি পদে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু পরিদর্শক থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ।

জানা গেছে, সম্প্রতি রাজারবাগ পুলিশ অডিটরিয়ামে আইজিপির সঙ্গে বিশেষ কল্যাণ সভায় বৈষম্য দুর করার প্রস্তাব করা হয়। নির্বাচনকালীন সময়ে থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পাবেন – এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন যেসব কর্মকর্তারা ; তাদের স্বপ্নও উড়ে গেছে থানা প্রতি উচ্চ রেটে।

জানা গেছে, পুলিশ পরিদর্শক পদটি দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ২০১২ সালে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে উন্নীত করা হয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত নন-ক্যাডার (নবম গ্রেড) কর্মকর্তারা ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পান। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে নবম গ্রেডের কর্মকর্তারা পদোন্নতির পরও নবম গ্রেডে থেকে যান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৩৫ পুলিশ পরিদর্শকের পদোন্নতির আবেদনে প্রজ্ঞাপন সংযুক্ত করে বৈষম্য দুর করার দাবি তুলেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ পরিদর্শকদের নবম গ্রেড থেকে পদোন্নতি দেওয়ার পর নবম গ্রেডে থেকে যাওয়ায় তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নন-ক্যাডার কর্মকর্তার তুলনায় পুলিশ কর্মকর্তারাই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। পুলিশে জমাট বাঁধা বৈষম্য দুর করা সময় সাপেক্ষ বিষয় হলেও, নির্বাচনকালীন সময়ে দায়িত্বের সুসম বন্টন করে মাঠ প্রশাসনের ক্ষোভ কিছুটা হলেও দুর করা যেত এমন বিশ্লেষণ সংশ্লিষ্টদের।