রমজানে রোজার উপকারিতা ও স্বাস্থ্যকর খাবার

    রমজান মুসলিম বিশ্ব ও উম্মাহের জন্য ফজিলতময় ও তাৎপর্যপূর্ণ মাস। পবিত্র হাদিস শরিফ থেকে জানা যায়, নবীজী (সা.) ইফতার করতেন, তাজা খেজুর দিয়ে, যদি তাজা খেজুর না পাওয়া যেত, তবে শুকনো খেজুর দিয়ে যদি তাও না পাওয়া যেত তবে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিতেন; এরপর তিনি মাগরিবের নামাজ পড়তেন।

    আজ আমরা রমজানকে বানিয়েছি খাদ্য উৎসবের মাস। শুধু তাই নয়, আত্মশুদ্ধির এ মাসে আমরা যেন ভোজন দাসে পরিণত হয়েছি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যয়বহুল ইফতার পার্টি আর নামি হোটেলে সেহরি খাওয়া ইত্যাদি যেন একটা স্ট্যাটাসে পরিণত হয়েছে।

    ধর্মাচারের এসব অবিদ্যার কারণে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি রমজানের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক উপকার থেকে। সেই সঙ্গে আমরা নিজের শরীরকে ঠেলে দিচ্ছি ভয়ংকর সব শারীরিক ঝুঁকির দিকে।

    আমাদের দেহের অ্যান্টারিওর গ্ল্যান্ড থেকে ‘আই জি এফ-১’ নামে এক ধরনের গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হয় যার কাজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কোষ তৈরি করে দেহকে বাড়ন্ত রাখা।

    এ কোষ পুরনো কোষ মেরামত ও ক্ষয়পূরণের চেয়ে নতুন কোষ তৈরিতেই বেশি সক্রিয়। আমরা যত বেশি প্রোটিন জাতীয় খাবার খাই তত বেশি ‘আই জি এফ-১’ হরমোন আমাদের শরীরে তৈরি হবে।

    কোনো বিরতি বা বিশ্রাম ছাড়া শুধু নতুন কোষ তৈরিই নয় এ সুযোগে দেহে বাসা বাঁধতেও পারে ডায়াবেটিস কিংবা ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি। গবেষণায় দেখা গেছে, স্টোন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সারের সঙ্গে ‘আইজিএফ-১’-এর একটা যোগসূত্র আছে।

    ভিন্ন এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় ‘আইজিএফ-১’ হরমোন আছে এমন একজন ব্যক্তিকে মাত্র ৩ দিন উপবাস রেখে সেই ‘আইজিএফ-১’ হরমোনের মাত্রা কমিয়ে ফেলা হয়েছে, যে ব্যক্তির কিনা প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি খুবই প্রবল ছিল।

    স্বাস্থ্যক্ষেত্রে রমজানের উপকারিতা

    ১.রোজা বা উপবাস ডায়েটিংয়ের চায়েও ভালো ফল দেয়।

    ২.রোজা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।

    ৩.রোজা বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমন : স্টোন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখে।

    ৪.রোজা পেপটিক আলসারের উপসর্গ সাড়ায়।

    ৫.আলঝেইমার, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রমের মতো বয়সজনিত রোগগুলো থেকে বাঁচাতে পারে।

    ৬.রোজা বিভিন্ন নেশাদ্রব্য থেকে দূরে রাখে।

    ৭.রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণে রাখে।

    ৮.শরীর ও মনকে শান্ত রাখে।

    এসব উপকার পেতে হলে রোজা সঠিক খাদ্যাভ্যাসে রাখতে হবে। রমজান মাসে খাবারের সময়ের পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবর্তন হয় খাবারের মেন্যুতেও।

    রোজায় সাধারণত ৩টি সময়ের সমন্বয়ে আমরা খাবার খেয়ে থাকি- ইফতার, রাতের খাবার, সেহরি। পুরোরোজায় সুস্থ থাকতে খেয়াল রাখতে হবে সেই খাবার যেন হয় সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর।

    রমজান মাস এলেই অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও মসলাযুক্ত খাবারের প্রবণতা বেড়ে যায়। খাদ্য সংযমের এই মাসে সবাই আমরা নেমে পড়ি এক ধরনের আহারের প্রতিযোগিতায়।

    সারা দিন রোজা রেখে পাকস্থলি খুব ক্ষুধার্ত ও দুর্বল থাকে, তার সঙ্গে অতিরিক্ত ভাজাপোড়া ও মসলাযুক্ত খাবার খেয়ে হতে পারে পেটের সমস্যা, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, আলসার, অ্যাসিডিটি ও হজমের সমস্যাসহ নানারকম শারীরিক জটিলতা। রোজায় খুব দামি খাবার খেতে হবে তা নয় বরং সুষম ও সহজপাচ্য পুষ্টিকর খাবার খেলেই খুব সহজেই সুস্থ থাকা যায়।

    ইফতার

    ইফতারের মেন্যু এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে তা যেন পরিবারের সবার উপযোগী হয়। মেন্যুতে রাখা যেতে পারে- খেজুর, কারণ খেজুরের সুক্রোজ পানির সঙ্গে মিশে তাৎক্ষণিক প্রাণ শক্তি দেয়।

    এর সঙ্গে যে কোনো ন্যাচারাল অ্যানার্জি ড্রিংক যেমন- তাজা ফলের রস, ডাবের পানি, লাচ্ছি, তোকমার শরবত, আখের গুড়ের শরবত, লেবুর শরবত ইত্যাদি।

    শরবত তৈরিতে মিছড়ি, গুড়, মধু ও ব্রাউন সুগার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে চিনির পরিমাণ কম দেয়াই শ্রেয়। যে কোনো মৌসুমি ফল বা এসব ফল দিয়ে তৈরি ডেজার্ট রাখতে পারেন, যা সারা দিন রোজা রাখার পর দেহে ভিটামিনস ও মিনারেলসের চাহিদা পূরণ করবে।

    এছাড়া সবজি দিয়ে যে কোনো রেসিপি যেমন- সবজি স্যান্ডউইচ, সবজি পাকোরা, সবজি নুডলস, সবজি রোল, সবজি স্যুপ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। পুরোরোজার ৩০টি দিন ডালের বড়া না খেয়ে মাঝে মাঝে খেতে পারেন কারণ ডাল শরীরে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়িয়ে ফেলতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে রান্নায় তেলের ব্যবহার যেন কম হয়। তেলের রং কালচে হলে, তেল বদলানো ভালো।

    বারবার একই তেলে ভাজা হলে তেল কালচে, আঠালো হয় এবং এর স্বাদ ও গুণগত মান নষ্ট হয়। ইফতারির অতি পরিচিত খাবার ছোলা, এটি প্রোটিনেরও ভালো উৎস তবে মসলাযুক্ত ভুনা ছোলা না খেয়ে কাঁচা ছোলা অথবা সিদ্ধ ছোলার সঙ্গে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, শসা, টমেটো ইত্যাদি মিলিয়ে খেলে তা স্বাস্থ্যকর এবং একইসঙ্গে আপনি প্রোটিন এবং ফাইবার পেয়ে থাকবেন।

    ইফতারিতে জিলাপি, বুন্দিয়ার পরিবর্তে ঘরে তৈরি মিষ্টির যে কোন রেসিপি যেমন- ফালুদা, কাস্টার্ড, পুডিং, ফিরনি হতে পারে। দই চিড়া ইফতারিতে রাখা যায়

    যা কার্বহাইড্রেট, প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম এর ভালো উৎস।

    রাতের খাবার

    রোজার সময় ইফতারির পর অনেকেই ঠিক সময়ে রাতের খাবার পরিমান মতো খান না অথবা অনেকেই ইফতারের পর রাতের খাবার বাদ দিয়েই সেহরিতে চলে যান।

    এ দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। রোজার সময় ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে বলা হয়ে থাকে পরিমিত পুষ্টিকর খাবার বারে বারে গ্রহণ করা স্বাস্থ্যসম্মত। ঠিক সেই বিষয়টিই রোজার সময় এ ৩টি সময়ের মাধ্যমে তা পূরণ করতে হবে। তারাবি নামাজের পর আপনি যেন ক্লান্তিবোধ না করেন এবং একটা ভালো ঘুম হয় সেজন্য রাতের খাবার খেতে হবে পরিমিত পরিমাণে।

    সেই খাবার হতে হবে কার্বহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিনস এবং মিনারেলস সমৃদ্ধ খাবার। যেমন- সামান্য পরিমাণে ভাত, শাকসবজি, মাছ/মুরগির মাংস ১ টুকরো।

    গরু বা খাসির মাংস না খাওয়াই শ্রেয়, দুধের সঙ্গে অল্প পরিমাণে ভাত বা ওটস হতে পারে, রুটি সবজি, ডিমের সাদা অংশ ইত্যাদি। কোমল পানীয় বাদ দিয়ে এ ৩টি সময় মিলে কমপক্ষে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করতে হবে।

    সাহরি

    সারা দিন খাবার খাওয়ার সুযোগ নেই বলেই অনেকে সাহরিতে খাবারের পরিমাণ বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। আবার অনেকেই কিছুই না খেয়ে অথবা সামান্য কিছু একটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছেন।

    এর কোনোটাই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কারণ, পরের দিনে আপনার কতটুকু প্রাণশক্তি থাকবে, পুরোরোজায় আপনার স্বাস্থ্য কতটুকু ভালো থাকবে তার অনেকটা নির্ভর করে এ সাহরির ওপর।

    ফজরের নামাজের কিছুটা আগে যদি আপনি সাহরিটা সেরে ফেলেন তবে, আপনি সারা দিন বেশ কর্মক্ষম থাকবেন এবং বার বার ক্ষিদে, তৃষ্ণা পাবে না। তবে সাহরির খাবার কি রকম হবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহরিতে এমন কিছু খাবার নির্বাচন করতে হবে যা সহজেই হজম করা যায়। যেমন- ভাত খুবই সহজপাচ্য, এর সঙ্গে মাছ, সবজি নিতে পারেন। এছাড়া চিড়া, দই, কলা, আম, দুধ-ভাত সাহরির জন্য বেশ উপযোগী।

    তবে কম তেল যুক্ত খাবার এবং চিনির ব্যবহার কম রাখাই ভালো। অনেকে সাহরিতে চা/কফি খেয়ে থাকেন। এ রোজায় সেই অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। এ চা/কফি সাময়িক সময়ের জন্য আপনাকে সতেজ করলেও পরবর্তী দিনে আপনার পানির তৃষ্ণা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে।

    রোজায় ব্যায়াম

    রোজার সময় হাঁটা ও ব্যায়ামের সময়সূচি পরিবর্তন করে নিতে পারেন। সারা দিন রোজা রেখে সাঁতার কাটার মতো কর্মকাণ্ডও বজায় রাখতে পারবেন তবে শরীরে অতিরিক্ত ঘাম বা পানিশূন্যতার সৃষ্টি হলে তা থেকে বিরত থাকাই ভালো। এছাড়া হালকা ব্যায়াম, মেডিটেশন ও ইয়োগা করতে পারেন।

    যদি মাথা ঘোরা বা দুর্বল লাগে তবে অবশ্যই হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়ামের গতি কমিয়ে অথবা বন্ধ করে দিতে পারেন।

    বিএম/রনী/রাজীব