বাবুর্চির ইশারায় চলে নকল ঘি! ব্রান্ডের প্যাকেট ডুকছে রঙ, পামওয়েল, সুজি, গাম!

    **চট্টগ্রামে নকল ঘি-তে বাজার সয়লাব** হাটহাজারীতে নকল ঘি কারখানার সন্ধান** শতকরা ৯০ শতাংশ লাভ**

    রাজীব সেন প্রিন্স, বিশেষ প্রতিবেদন : ঘি খাবারের স্বাদকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয় আর এর গন্ধ অতুলনীয়। ঘি-তে থাকে ভিটামিন ডি, ও ‘কে’। অন্যান্য উপাদানের চেয়ে ভিটামিন এ ও ই-এর চমৎকার উৎস ঘি। আলসার ও কোষ্টকাঠিন্য এবং স্বাস্থ্যকর চোখ ও ত্বকের চিকিৎসায় ওষুধ তৈরিতে ঘি ব্যবহার করা হয়। তবে যদি হয় ভালোমানের ঘি।

    বর্তমান বাজারে যা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। ঘি আছে ঠিকই কিন্তু তাতে নেই ঘি তৈরির মূল উপাদান। কঠোর কোন আইনী পদক্ষেপ না থাকায় পুরো বছর জুড়ে চট্টগ্রাম নগর ও জেলার বিভিন্ন হাট বাজারে চলে ভেজাল ঘিয়ের রমরমা বাণিজ্য। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অবাধে সরবরাহ করা হচ্ছে অজ্ঞাত স্থানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি এসব ভেজাল ঘি। ভেজাল হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যের মোড়কগুলো কিন্তুনামী দামী ব্রান্ডের।

    জানা যায়, ২৫ শতাংশ খাঁটি ঘি এর সঙ্গে সয়াবিন, পামওয়েল, ডালডা, সুজি পশুর চর্বি, ভেজিটেবল ফ্যাট, আলুর পেস্ট, সুজি, বিভিন্ন ধরনের গাম, রাসায়নিক দ্রব্য, রং ও ফ্লেভার ব্লেন্ড করে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল ঘি। এতে আসল দামে নকল ঘি কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হলেও শতকরা ৯০ শতাংশ লাভ করছে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর লাভের অর্ধেক যায় বাবুর্চির পকেটে।

    নগরীর কয়েকটি বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকানে বিএসটিআই অনুমোদন বিহীন ক্ষতিকর ঘি-তে বাজার একেবারে সয়লাব। ভেজাল ঘি বজারজাত করতে বেশ কিছু দোকানদার, বাবুর্চিও এই চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে।

    মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান দিয়ে তৈরি বিভিন্ন বেনামি কোম্পানির এসব ভেজাল ঘি বিক্রির এক ধরনের প্রচারে নেমেছেন চট্টগ্রামের নামিদামি বাবুর্চিরা। বিয়ে ও নানান সামাজিক অনুষ্ঠানের খাবারের আয়োজনে অন্যান্য ফর্দ্দের সাথে তাদের নির্দ্দিষ্ট ভেজাল ঘিয়ের নামটি উল্লেখ করে দেন বাবুর্চিরা।

    নকল ঘি

    বিভিন্ন দোকানের মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে বার্বুচিরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় এইসব ঘি তাদের ফর্দে লিপিবদ্ধ করলে তাদের বিকিকিনি বাড়ে। এজন্য নতুন পুরাতন এলাকা ভিত্তিক পরিচিত বাবুর্চিদের হাতে রাখে ভেজাল ঘি কোম্পানীর প্রতিনিধিরা। বিক্রি বাড়াতে প্রতি বছর এসব বাবুর্চিদের দেয়া হয় মোটা অংকের বকশিষ। এতে করে সাধারণ ক্রেতারা যেমন প্রতারিত হয় তেমনি লিভার সিরোসিজ ও জন্ডিসের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার রোগী।

    বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, চট্টগ্রাম নগরীর কর্নেল হাট সি ডি এ রেল গেট পাশে সি এন জি গ্যারেজের ভিতরেই রয়েছে প্যারিস গাওয়া ঘি নামক একটি ভেজাল কারখানা। সি ডি এ শাপলা আবাসিকে রয়েছে নিউ স্টার। কাট্রলি কমিনিউটি সেন্টার পাশেই তৈরি হচ্ছে সুপার মিল্ক গাওয়া ঘিও। এরকম অসংখ্য ভেজাল প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের নাকের ডগায় ভেজাল ঘি তৈরি করলেও নজর নেই কোন তদারকি প্রতিষ্ঠানের।

    হাটহাজারীতে নকল ঘি তৈরির কারখানার সন্ধান : ২৭শ লিটার ধ্বংস : তবে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সম্রাট খীসার নের্তৃত্বে সোম ও মঙ্গলবার টানা দুদিনের অভিযানে সন্ধান মিলেছে এমনই দুটি ভেজাল ঘি কারখানার। যেখানে ফুটে উঠেছে নামী দামী ব্রান্ডের আড়ালে কোন উপায়ে ঘি বাজারজাত করা হচ্ছে।

    হাটহাজারী উপজেলার ১১ মাইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে সন্ধান মেলে এ ভেজাল ঘি কারখানার। দুদিনে ধ্বংস করা হয় প্রায় ২ হাজার ৭শ লিটার ভেজাল ঘি। তবে অভিযানের সময় এসব ভেজার ঘি তৈরির মূল মালিকদের পাওয়া যায়নি।

    সোমবার (১১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় হাটহাজারী পৌরসদরের এগারো মাইল এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১৫০০ লিটার ভেজাল ঘি ধ্বংস করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেদিন কারখানার মালিককে পাওয়া যায়নি। ফলে পরদিন দুপুরে ওই এলাকার কবির চেয়ারম্যানের বাড়িতে ফের অভিযান পরিচালনা করলেও ধরা পড়েনি মূল অপরাধী। এ সময় ভেজাল ঘি তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত লাল সার, ডালডা, পামওয়েল, ফ্লেভার, ক্ষতিকর রং সহ বিভিন্ন উপকরণ জব্দের পাশাপাশি ১ হাজার ২০০ লিটার ভেজাল ঘি নষ্ট করা হয়।

    দুটি অভিযানে ভেজাল ঘি তৈরির কারখানায় পাওয়া যায় নামী দামি ঘি প্রতিষ্ঠানের আকর্ষনীয় সব মোড়ক। যার মধ্যে রয়েছে বাঘাবাড়ী স্পেশাল খাঁটি গাওয়া ঘি, গোল্ডেন এসপি, গোল্ডেন পিএম, গোল্ডেন স্পেশাল, আর এস রাজেশ ঘোষ সুপার বাঘাবাড়ী, থ্রি স্টার, প্রিমিয়াম ও থ্রি স্টার গোল্ড জিএম।

    অভিযানে দেখা যায়, ক্ষতিকর রঙ, পামঅয়েল, সুজি, গাম, হলুদ এবং লাল রঙের সারজাতীয় কিছু দ্রব্য ও এক ধরনের সুগন্ধি মিশ্রিত করে তৈরি করা হচ্ছে ভেজাল ঘি। পরে তা নামি-দামি প্রতিষ্ঠানের মোড়কে খাঁটি গাওয়া ঘি নামকরণ করে সারা দেশে বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।

    অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, তাদের কাছে আগে থেকেই খবর ছিলো উপজেলার এগার মাইল এলাকার কবির চেয়ারম্যানের দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে কিছু অসাধু ব্যাক্তি ক্ষতিকারক উপাদানে নকল ঘি তৈরি করছে। ভেজাল ঘি তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়ার পর সেখানে দুদিন অভিযান পরিচালনা করলেও আসল মালিককে পাওয়া যায়নি। তবে অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে ভেজাল ঘি তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম। ধ্বংস করা হয়েছে বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত রাখা প্রায় ২৭শ লিটার ঘি।


    হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনের নের্তৃত্বে নকল ঘি তৈরির কারখানার সন্ধান

    রুহুল আমিন বলেন, এসব ভেজাল ঘি তৈরির মালিকরা বাবুচিদের প্রতি কেজিতে ২৫০/৩০০টাকা দিয়ে এব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। তিনি এ কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, যারা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ভেজাল খাদ্য তৈরি করবে এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রি করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

    এদিকে এসব ভেজাল ঘিতে ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরে চিকিৎসকরা বলেন, এসব ঘি খাওয়ার ফলে জন্ডিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি, লিভার, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছে হাজারো রোগী।

    বিএম/রাজীব সেন প্রিন্স…