মন্দমানের ঋন ৯৪ দশমিক ২৫
ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপী ঋনে রেকর্ড

ওয়াহিদ জামান :::

চরম ডলার সংকট অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের ঋন বিতরণে ধরা পড়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের  মোট বিতরন করা ঋনের বড় অংশই খেলাপির খাতায়। মোট বিতরন করা  মন্দমানের ঋনের পরিমান প্রায় ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। করোনাকাল এবং বৈশ্বিক মন্দাবস্থার জন্য ঋনের এমন চিত্র ; এমন ব্যাখাকে মেনে নিতে নারাজ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। অর্থপাচারে লাগাম টানতে না পারার কারণে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পাচার করা হয়েছে বিদেশে। দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে খেলাপি ঋণের এই হারও  সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে বহুগুণ বেশি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঋনখেলাপির সহনীয়  পরিমাণ তিন শতাংশ ।এছাড়া মন্দমানের ঋণই রয়েছে ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা বা ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। এমন পরিসংখ্যান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরন ও আদায়ে চরম অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চিত্র স্পষ্ট করেছে।  ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ৪৬ দশমিক ৭৯ শতাংশই সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী গত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর ‘খেলাপি ঋণ’ ছিল এক লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সেই হিসাবে গেল বছর (২০২২ সাল) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। গেল বছর খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ‘অর্থনৈতিক সংকট ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে অনুযায়ী দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত ১০ বছরে অন্তত ৩ গুণ বেড়েছে। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২৭.২৫ বিলিয়ন টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে  খেলাপি ঋণের এই অংকের পরিমাণ ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকা।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি সুদে নামে-বেনামে বিভিন্ন  প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে। যার কারণে এসকল প্রতিষ্ঠান যথাসময়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পাড়ায় খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে।এছাড়া কোভিডের কারণে গত ২০২০ ও ২০২১ বছরে ঋণে পরিশোধে বড় ধরনের ছাড় ছিল। ২০২২ সালে  ঋণ পরিশোধে ছাড়ের সুবিধা উঠে যাওয়াও খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টদের মতে দেশে সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋনের পরিমান প্রদর্শিত অংকের চেয়ে বেশি। ঋণ অবলোপন, ঋণ পুনঃতফসিলসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছে। সরকারি আর বেসরকারি ব্যাংকখাতের নিজেদের ব্যালেন্সশিটে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে বলেও মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

খেলাপি ঋণের বিষয়ে  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ বাংলাদেশ ব্যাংক যে খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান দিচ্ছে, এটি আসলে আন্তর্জাতিক মানের নয়। কারণ এখানে অনেক তথ্য উল্লেখ করা হয় নি। আবার খেলাপির অংক কম দেখাতে অনেক তথ্য যোগ করা হয় না। ঋণ পুনঃ তফসিল, পুনর্গঠন ও ঋণ অবলোপন করার তথ্য দেওয়া হয় না পরিসংখ্যানে। বিশেষ ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হয় শুধুমাত্র আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর জন্য, যা কখনোই মানসম্পন্ন বলা যাবে না। ‘

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী   ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে দেশের ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমান ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসেবে মোট ঋণের ৮.১৬ শতাংশই খেলাপি। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা।

১৯৯০ সালে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। ২০০৯ সালেও এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এখন সেটি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ একই বছরের জুন মাস শেষেও খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। তারও তিন মাস আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়  শুধু গেল বছরের  জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে ঋণ খেলাপি বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

দেশে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংক  ৬৪.৫১ শতাংশ ধারণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, শীর্ষ ১০ খেলাপি ব্যাংকগুলো হলো- ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি), আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, বিডিবিএল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) এবং রূপালী ব্যাংক।

সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ খেলাপির পরিমান দেশের অর্থনীতির সংকটকে আরও ঘনীভূত  করবে  বলে মনে করেন  বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফ ‘র তথ্যমতেও বাংলাদেশে বিতরণকৃত ঋণের এক তৃতীয়াংশই খেলাপি। আইএমএফের ঋণের সব অর্থ  (কিস্তি) পেতে সরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার শর্ত দেয়া হয়েছে । আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ হতে হবে ৫ শতাংশের নিচে । বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলো মোট ঋণের ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ আর বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ১২ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার ৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আইএমএফের ঋণের সব কিস্তি পেতে হলে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনায় আরো তৎপর হতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে করোনা পরিস্থিতিতে  সব ধরনের ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে কোনো গ্রাহককে নতুন করে ঋণখেলাপি হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়নি। সেই সময়ে উল্টো ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা হিসেবে প্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণের অর্ধেক সুদ বহন করে সরকার। তবে এত সুবিধা দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের মিটার নামেনি। ঋণ গ্রহীতারা নীতিছাড়ের একই সুবিধা ভোগ করেছেন ২০২২ সালেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালাও সহজ করেছে। অকারনে ব্যাংকগুলোই ঋণ পুনঃতফসিলের সব ক্ষমতা পায়। এত ছাড়ের পরও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ রেকর্ড গড়েছে।

বা.মে/মামুন