শেয়ারবাজারে কমন ভুলগুলো


    সিহাব হাসান

    অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সম্ভাব্য করপোরেট আয়, তহবিলের প্রবাহ আর বাজারের সেন্টিমেন্ট ইত্যাদি নানা কিছু মিলিয়ে আগামী কয়েক বছর দেশের শেয়ারবাজার থেকে ভালো মুনাফা পাওয়া যাবে বলেই বিশ্বাস করছেন বেশির ভাগ বিশ্লেষক। দর্শনগত দৃষ্টিভঙ্গি আর ফলপ্রসূ কৌশলের প্রয়োগ এমন পরিস্থিতিতে বড় মুনাফার সুযোগ এনে দেয়। তার পরও দেখা যায়, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই তা কাজে লাগাতে পারেন না। বিশ্বের সব শেয়ারবাজারেরই বাস্তবতা এটি। এজন্য সাধারণত জানা-বোঝার অভাবকেই দায়ী করি আমরা। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলে থাকেন, যথেষ্ট জানাশোনার পরও বিনিয়োগকারীর চিন্তাজগতে কিছু কমন উপাদান রয়ে যেতে পারে, যেগুলো বাজারে তার আচরণকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে এবং মুনাফার পথে বিশাল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এর কয়েকটি একদম মোটা দাগের ভুল, যা এড়িয়ে চলা আবশ্যক। নানা শিরোনামে বহু নিবন্ধে এ বিষয়গুলো তুলে এনেছেন উন্নত বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা। তাদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা নিয়েই এ রচনা…

    মৌলিক ধারণাগুলো অর্জন না করে আমরা পৃথিবীর কোনো কাজেই সফল হতে পারি না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তো আরো অসম্ভব। বাজারে কোনো পণ্য কিনতে যাওয়ার আগে আমরা এর মান, সোর্স, মূল্যস্তর কত কিছুই না যাচাই করি। কিন্তু শেয়ারবাজারে ন্যূনতম ধারণা না নিয়ে কোনো যাচাই-বাছাই না করে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বসছেন— এমন মানুষের সংখ্যা যে কম নয়, তা আমাদের চারপাশে তাকালেই স্পষ্ট হয়। শেয়ারবাজারে সাধারণ মানুষের বড় বড় লোকসানের দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর দেশে নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রকরা সর্বস্তরে মৌলিক বিনিয়োগ শিক্ষার প্রসারে জোর দিয়েছেন। এগুলো নিঃসন্দেহে একজন বিনিয়োগকারীকে বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। তার পরও বিনিয়োগকারীর চিন্তা ও আচরণে এমন কিছু উপাদান থেকে যায়, যেগুলোকে উন্নত বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা ‘রেসিপি ফর ডিজাস্টার’ বা ‘এনাফ টু বি লুজার’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেন। সবাই একমত, মোটা দাগের এ ভুলগুলো এড়িয়ে চলতেই হবে।

    বিনিয়োগ না ট্রেডিং?

    শেয়ারবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সবচেয়ে কমন সমস্যা হলো, বিনিয়োগ আর ট্রেডিংয়ের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা। দুটিই শেষ পর্যন্ত মুনাফার জন্য। তবে দুইয়ের মধ্যে রয়েছে যোজন যোজন পার্থক্য।

    আজ শেয়ার কিনে পরের দিন বা পরের সপ্তাহে বিক্রি করে দেয়ার ইচ্ছাকেও ব্যবহারিক জীবনে আমরা বিনিয়োগ বলে অভিহিত করছি, যা একটি বড় সমস্যার উৎস। নথিপত্র বা সংবাদ প্রতিবেদনেও আমরা বাজারের সব লগ্নিকারককেই বিনিয়োগকারী বলে ডাকছি। অথচ এ ‘বিনিয়োগকারী’দের একটি বড় অংশ নিছকই ট্রেডিং করেন।

    বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ট্রেডারের পার্থক্য দর্শনে, চিন্তায়, চাওয়ায় এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ভিত্তিতে। একজন বিনিয়োগকারী কোম্পানির মালিকানা ধারণ করেন। তার কাছে একটি পুরো কোম্পানি কেনা আর এর কয়েকটি শেয়ার কেনা একই বিষয়। বিনিয়োগকারী সংশ্লিষ্ট সম্পদের অন্তর্নিহিত মূল্য নিয়ে ভাবেন। কোম্পানিটির ব্যবসা কেমন চলছে, আগামীতে ব্যবসা আরো ভালো হবে না খারাপ হবে— এগুলোর অনুসন্ধান করেন। তিনি আগামীতে কোম্পানির ব্যবসায় উন্নতির প্রত্যাশায় থাকেন। সে প্রত্যাশা পূরণ হলে কোম্পানি থেকে ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, সেকেন্ডারি বাজার তাকে মূলধনি মুনাফা দেয়। আবার ব্যবসার অবস্থা খারাপের দিকে যাবে বলে আশঙ্কা করলে বিনিয়োগকারী তার মালিকানা ছেড়ে দেন। অন্যদিকে ট্রেডাররা নিছকই সেকেন্ডারি বাজারে দামের উত্থান-পতনের হিসাব করেন। এর মৌলভিত্তিক কারণ বা শেয়ারের অন্তর্নিহিত মূল্য নিয়ে তারা মোটেও সিরিয়াস নন। বাজার বুঝে যেকোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার হাতবদল করলেই তার মুনাফা।

    লগ্নির মেয়াদও বিনিয়োগকারী ও ট্রেডারের পার্থক্যের একটি বড় পয়েন্ট। কোম্পানির ব্যবসায়িক অবস্থায় রাতারাতি পরিবর্তন আসে না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এ কারণে বিনিয়োগকারীও লম্বা সময়ের জন্য শেয়ার ধরে রাখার মানসিকতা পোষণ করেন। কিংবদন্তি বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট বলেছেন, এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করুন, যাতে শেয়ারবাজার এক-দেড় দশকের জন্য বন্ধ হয়ে গেলেও আপনাকে কোনো দুশ্চিন্তা করতে না হয়। অর্থাৎ তিনি নিছক হাতবদল করার সুবিধাকে গুরুত্ব দেন না। বরং কোম্পানির প্রকৃত মালিক হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রকৃত সুফল প্রাপ্তিটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেকেন্ডারি বাজার থেকে আসা মূলধনি মুনাফা তার দৃষ্টিতে নেহাতই বাই-প্রডাক্ট। তারা বলেন, বিনিয়োগকারীর আরাধ্য কোম্পানির ভ্যালু ও গ্রোথ। এখানে কোনো দুর্বলতা না পেলে তিনি তার পজিশন নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। সেকেন্ডারি বাজারে অন্যরা কী করছেন তা নিয়েও তিনি চিন্তিত নন। তার দৃঢ় বিশ্বাস, অবমূল্যায়িত শেয়ারটি একসময় অন্তত যথামূল্যায়িত হবে।

    অন্যদিকে ট্রেডারের সবচেয়ে বড় বন্ধু শক্তিশালী ট্রেন্ড। ট্রেন্ডি বাজারে কিছু মুনাফার বিনিময়ে একজন ট্রেডার কয়েক মিনিট পরই তার শেয়ারগুলো বিক্রি করে দিতে পারেন। আবার শক্তিশালী ও টেকসই ট্রেন্ড দেখলে সে শেয়ারে বছরজুড়েই পজিশন ধরে রাখতে পারেন। বিষয়টি তাদের ট্রেডিং স্টাইল ও কৌশলের ওপর নির্ভর করে। চাহিদা ও ট্রেন্ড সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হলে উচ্চ পিই, অতিমূল্যায়ন এগুলো তাদের পথে বিশেষ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

    এখন কোনটি বেশি লাভজনক এবং কোনটি করা উচিত— এগুলো নিয়ে বিতর্ক শেষ হওয়ার নয়। তবে আমাদের যেকোনো এক দলে থাকতে হবে। নতুবা পরস্পরবিরোধী পরিস্থিতির শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত নিষ্ফল অংশগ্রহণটুকুই সার হতে পারে। টুর্নামেন্ট শেষে লোকসানের আশঙ্কাও কম নয়।

    একটি উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করা যাক। ধরুন, মন্দাচক্রের শেষ ভাগে একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম এর অভিহিত মূল্যের কাছাকাছি নেমে এসেছিল। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীরা সেটিকে অবমূল্যায়িত মনে করে সেখানে বিনিয়োগ করলেন। অবশ্যই ধৈর্য নিয়ে। কিন্তু ট্রেন্ড ট্রেডার সেখানে যাবেন না। কারণ তার চার্ট বলছে, শেয়ারটি নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে অর্থনীতি ও শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াল। দেখা গেল, কোম্পানির ব্যবসা ভালো হতে শুরু করেছে, শেয়ারের দামও ২০ টাকা পেরিয়ে গেল। ভ্যালু ইনভেস্টর তার কৌশল অনুসারে যথা বা অতিমূল্যায়িত মনে করে শেয়ারটি বিক্রি করে দিল।

    একই মৌসুমে টেকনিক্যাল চার্টে ব্রেকআউট দেখা যাচ্ছে, যা একটি শক্তিশালী ট্রেন্ডের সূচনা করতে পারে বলে মনে করছেন ট্রেডাররা। একই সময় স্টক এক্সচেঞ্জে ডিসক্লোজার এল, টানা কয়েক প্রান্তিক ধরে বাড়তে থাকা ইপিএসটি এবার কমে গেছে। কোম্পানির পিই অনুপাত বেড়ে গেছে।

    এখন প্রশ্ন হলো, কোন পরিস্থিতিতে আপনার করণীয় কী?

    উত্তর হবে, আপনি প্রথমে ঠিক করবেন আপনি কোন গ্রুপের সদস্য। আপনি যদি বিনিয়োগকারী হন, আপনাকে মৌলভিত্তির কথা মাথায় রেখে অবমূল্যায়িত অবস্থায়ই শেয়ারটি কিনতে হতো। অবমূল্যায়িত অবস্থায় না কিনলে বাজারের উত্থান পর্বে অন্তত যথামূল্যায়িত বর্ধনশীল কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে আপনাকে। কোম্পানির প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা অব্যাহত থাকা পর্যন্ত বা অতিমূল্যায়নের আগ পর্যন্ত এটি ধারণ করতে হতো।

    আর যদি আপনি ট্রেডিং করেন, তাহলে আপনার শাস্ত্র অনুসারে ভ্যালু ইনভেস্টরের বেচে দেয়া শেয়ারটিই কিনে নিতে হবে। এ সময় উচ্চ পিই অনুপাত বা এক প্রান্তিকের ইপিএস কমতে দেখে ভড়কে গেলে আপনি গেম থেকেই ছিটকে পড়লেন।

    আবার উল্টোভাবে দেখলে, ধরুন আপনি একজন ভ্যালু ইনভেস্টর। কিন্তু নিছক বাজারে ট্রেন্ডি বলেই আপনি বিক্রি করার বদলে একই শেয়ার আরো কিনে নিচ্ছেন, তাহলেও আপনি আপনার গেম থেকে ছিটকে পড়লেন। হতে কি পারে না, এ শেয়ার থেকে মুনাফা তুলে নেয়ার পর আপনার জন্য আরেকটি অবমূল্যায়িত শেয়ার অপেক্ষা করছে।

    আপনি হয়তো দেখবেন, দুইয়ের মিশ্রণে অনেক বিনিয়োগকারী আরো ভালো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, তারা সুনির্দিষ্ট জ্ঞান, তথ্য প্রাপ্তি ও বিশ্লেষণ এবং বিচক্ষণতার একটি উচ্চপর্যায়ে উন্নীত অবস্থান করছেন। এক্ষেত্রে আপনার জন্য পরামর্শ, ডোন্ট ব্রেক রুলস আনটিল ইউ এক্সেল দিজ।

    সারা পৃথিবীরই বাস্তবতা হলো, শেয়ার কেনা, ধরে রাখা, বিক্রি করা— প্রতিটি পর্বেই পদে পদে আপনাকে দ্বিধায় ফেলে দেবে এ দুইয়ের জগাখিচুরি।

    এক্সিটের বাস্তবতা আরো নির্মম। ২০১০ সালের বাজারের কথাই ধরুন। যারা মৌলভিত্তি নিয়ে ভাবেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করেন, ওই বছরের দ্বিতীয়ার্ধে দেশের শেয়ারবাজারে এক ডজন কোম্পানিও ছিল না, যাদের শেয়ার অতিমূল্যায়িত নয়। বাজারের গড় পিই, খাতভিত্তিক পিই দেখেও সবাই বলছিলেন দেশের শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত। তার পরও বাজারে প্রতিদিন শতকোটি, হাজার কোটি টাকার তহবিল নিয়ে আসছিল বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এ পরিস্থিতিগুলোকে ভ্যালু ইনভেস্টরদের জন্য শেয়ার বিক্রির শেষ সময় বলে ধরে নেয়া হয়। কেউ কেউ নিশ্চয়ই বেচেছেনও। কিন্তু সিংহভাগই বিনিয়োগ বাড়িয়ে যাচ্ছিলেন। এটি নিছকই ট্রেডিং। সেকেন্ডারি বাজার থেকে কিছু উপরি কামিয়ে নেয়ার চেষ্টা; তা ব্যক্তিই করুক আর স্মার্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই করুক।

    বিশ্বজুড়েই ট্রেডারের রক্ষাকবচ স্টপলস। অর্থাৎ একটি শেয়ারে নেয়া পজিশনে আমি এত শতাংশের বেশি লোকসান বহন করব না। কিন্তু দেখা গেল, টানা কয়েক বছর বাজার পড়ছে, আর বিনিয়োগকারী ট্রেডার সবাই পুরো সময়টি তাদের শেয়ার নিয়ে ভালো ইপিএস কিংবা বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় রয়েছেন। মারাত্মক অতিমূল্যায়নের সে পর্বে বাড়তি মুনাফার জন্য অপেক্ষা করে বিনিয়োগকারী যেমন ভুল করেছেন, তেমনি পতনশীল বাজারে স্টপলস না দিয়ে ভালো কিছুর আশায় বসে থেকে ট্রেডারও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলাফল ঋণাত্মক ইকুইটির ধ্বংসস্তূপ, এখনো যার বোঝা টানছে বহু পোর্টফোলিও।

    সব পক্ষ বিনিয়োগ আর ট্রেডিংয়ের পার্থক্যটি স্মরণে রেখে নিজের কৌশলে অটল থাকলে সমস্যার মাত্রা নিঃসন্দেহে আরো কম হতো।

    ঝুঁকি  রিটার্নের অনুপাত

    ঢাকা-চট্টগ্রামের শেয়ারবাজারে আমরা হাজারো ট্রেডারের দেখা পাব, যারা বিশ্বাস করেন, ম্যাচিউরিটিতে বা দুয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০-১২ শতাংশ মুনাফা করতে পারাটাই সৌভাগ্যের। এক কথায় বললে, এটি একটি ধ্বংসাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি।

    কারণ স্টক এক্সচেঞ্জের সেটলমেন্ট সাইকেলের কারণে আমাদের বাজারে শেয়ার কেনার পর কমপক্ষে দুইদিন ধরে রাখতে হয়। কেনার পর এ দুইদিনে যেকোনো শেয়ারের দাম ১০ শতাংশ হারে কমে আপনার পোর্টফোলিওতে ১৯ শতাংশ লোকসান দেখাতে পারে। তৃতীয় দিনেও যদি শেয়ারটির ক্রেতা না থাকে, তাহলে আপনার এন্ট্রি আর এক্সিটের মধ্যবর্তী সর্বনিম্ন সময়েই ২৫ শতাংশের বেশি লোকসান হয়ে যেতে পারে। বাস্তবে হয়তো এটি সবসময় ঘটবে না। তবুও অন্তত কৌশল নির্ধারণের সময় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

    ইনভেস্টোপিডিয়ার খুব বেসিক নিবন্ধে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে অন্তত ৩ টাকা মুনাফার আশা থাকলে একজন বিনিয়োগকারী বা ট্রেডার সেখানে ১ টাকা লোকসানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেন। ম্যাচিউরিটিতে ১০-১২ শতাংশ মুনাফার জন্য শেয়ার কেনাবেচা করে ঢাকা-চট্টগ্রামের স্টক এক্সচেঞ্জে আমরা ঠিক উল্টোটি করছি না?

    যেহেতু এখানে ইন্ট্রাডে ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি, সেহেতু অন্তত তাত্ত্বিকভাবে বলতেই হবে, শেয়ার কেনার অর্থই হলো আপনার মূলধন অন্তত এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তার বিপরীতে ৫০-৭৫ শতাংশ মুনাফা আশা না করলে এন্ট্রি নিষ্প্রয়োজন। কারণ ম্যাচ শেষে যোগ-বিয়োগ করে আপনার মুনাফা প্রয়োজন।

    আরেকটু হিসাব করুন, আপনি বছরজুড়ে ১০টি শেয়ারে এন্ট্রি নিলেন। সাধারণত চাঙ্গা বাজারে অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ারের দামই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় থাকে। ধরলাম, আপনার ১০টি শেয়ারের মধ্যে সাতটির দামই কেনার পরপর বেড়েছে। আপনি ৭০-৮৫ শতাংশ মুনাফা পেলেন। অন্যদিকে তিনটি শেয়ারে ২৫ শতাংশের বেশি লোকসান হওয়ায় আপনি এ মুনাফার প্রায় সবটাই আবার বাজারকে দিয়ে দিলেন। ব্রোকারেজ কমিশন, আপনার পরিশ্রম সবই বৃথা গেল।

    কারো কারো বাস্তবতা হয়তো আরো নির্মম। কারণ তাত্ত্বিকভাবে যে সাতটি শেয়ারের দাম বাড়বে বলে আমরা ধরে নিচ্ছি, এ শেয়ারগুলো সারা বছর সমানতালে বাড়ে না। হ্রাস-বৃদ্ধির ছোট ও মাঝারি ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে শেয়ারদরের গড় ঊর্ধ্বমুখী থাকে। সাধারণ্যের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই দেখিয়েছেন, দ্রুত মুনাফা করতে গিয়ে আবেগতাড়িত ট্রেডারদের সিংহভাগই এ ঢেউয়ের ঠিক উল্টো পজিশনটি নেন। ব্রোকারেজ হাউজগুলোয় ঘুরে এলে এর সত্যতা মিলবে।

    গত মাসে কয়েকটি শেয়ারের দাম ৫০-৬০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে দেখার পর আজকের বাজারে যেকোনো দামে যেকোনো শেয়ার কেনার একটি তাড়না অনেক ট্রেডারকে আগ্রাসী করে তোলে। নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে এক সপ্তাহে ২০-২৫ শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়া শেয়ার থেকেও আপনি কিছু মুনাফা পেতে পারেন। কিন্তু সেটি শনাক্ত করার কোনো বিদ্যা কি জানা আছে? না থাকলে আমাদের উচিত হবে পরিসংখ্যানগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কম দামে শেয়ার কেনার চেষ্টা করা। এজন্য চাই শেয়ার ধরে রাখার মানসিক প্রস্তুতি। আপনি বিনিয়োগ করুন আর ট্রেডিংই করুন।

    সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডিএসইর দর ওঠানামার চিত্র দেখলে আমরা বলতে পারি, দু-তিন বছর ধরে রাখার প্রস্তুতি নিলে আপনি সমসাময়িক বাজারের সর্বনিম্ন স্তরে বিভিন্ন সেক্টরের ভালো ভালো শেয়ার পিক করতে পারবেন। এজন্য মৌলভিত্তির বেসিক বিষয়গুলো অন্তত মাথায় রাখতে হবে। সঙ্গে দরের দীর্ঘমেয়াদি চিত্র অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করবে।

    আর ট্রেডিং করতে চাইলেও স্বল্পমেয়াদি পজিশনের বদলে অন্তত মাস ছয়েক ধরে রাখার একটি প্রস্তুতি নিলে আপনি চারদিনে ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার পর শেয়ার কেনার প্রলোভন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। এর চেয়ে কম সময়ের মধ্যে আপনার প্রত্যাশিত মুনাফা চলে এলে তা তুলে নিতে অবশ্যই কোনো বাধা নেই।

    মূলধনের স্বরূপ অনুধাবন  মানি ম্যানেজমেন্ট

    মূলধনের স্বরূপ বিনিয়োগের বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আমরাও বিভিন্ন সময়ে বিশ্লেষণ করি, বাজারে কোন পক্ষের বিনিয়োগ বাড়ছে, কোন পক্ষের বিনিয়োগ কমছে। কারণ সব ফান্ডের ঝুঁকি গ্রহণের সক্ষমতা আর রিটার্ন টার্গেট সমান নয়। উন্নত বিশ্বের বিনিয়োগ তহবিলগুলো কম ঝুঁকিতে ডাবল ডিজিট রিটার্ন পেলেই খুশি। তাদের দেশে ব্যাংকে সুদ আমাদের মতো এত বেশি নয়। ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে তারা কন্ট্রারিয়ান ভ্যালু ইনভেস্টমেন্টের কৌশল অনুসরণ করে। আমাদের মতো বাজারগুলোয় ঘুরে ঘুরে এমন সময়ে শেয়ার কেনে, যখন স্থানীয়রা শেয়ারবাজারের পথ মাড়ায় না। ২০১০ সালের ধসের পর বিদেশী তহবিলগুলো ডিএসই-সিএসইতে এত কম দামে মৌলভিত্তির শেয়ার কিনেছিল যে, বাজার ঘুরে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই তাদের পুঁজি দ্বিগুণ হয়ে যায়। বড় মুনাফার আশায় তারা বর্ধনশীল কোম্পানির শেয়ারও যথামূল্যে কেনে।

    ধরুন, ভালো মুনাফা হচ্ছে দেখার পর একটি স্থানীয় ব্যাংক তাদের অনুমোদিত এক্সপোজার সীমার সর্বোচ্চটুকুই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ফেলেছে। কিন্তু এর পর পরই বাজারে একটি মধ্যমেয়াদি সংশোধন পর্ব শুরু হয়ে গেল। তাদের পোর্টফোলিওর সম্পদমূল্য কমে গেল। সঞ্চিতি সংরক্ষণেরও চাপ আসতে পারে ব্যাংকের ওপর। ব্যাংকের ফান্ড ম্যানেজার ভালোই বুঝতে পারছেন পরের বছর শেয়ারগুলোর দাম এখানে থাকবে না। এখন আরো কিছু শেয়ার কিনে নিলে গড় ক্রয়মূল্যটি কমত, আগামী বছরের জন্য ভালো একটি প্রস্তুতিও নেয়া হয়ে যেত। কিন্তু তিনি আর এটি পারছেন না, কারণ তার সব মূলধন এরই মধ্যে বিনিয়োগ করা হয়ে গেছে। ব্যাংকটি যদি এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থেকে মূলধনের একটি অংশ ফ্রি রাখত, তাহলে তারা লাভবান হতে পারত।

    চাঙ্গা অবস্থায় অতীতেও দেখা গেছে, মানি মার্কেটের স্বল্পমেয়াদি তহবিলও শেয়ারবাজারে চলে আসে। মানি মার্কেটের চেয়ে বেশি রিটার্নের জন্যই আসে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে মানি মার্কেট রেগুলেটরের অনেক নিয়ম-কানুন থাকে। তার পরও চলে আসে। স্বল্পমেয়াদি তহবিল লগ্নি করে চটজলদি কিছু মুনাফা করে নিতে পারলে ফান্ড ম্যানেজার খুব স্মার্ট প্রমাণিত হন। কিন্তু আটকে গেলে তিনিই চাপে থাকেন।

    ব্যক্তি আমাদের জন্যও একই বাস্তবতা। পরিবারের অতিরিক্ত তহবিল আর আগামী মাসের বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। ধার করা তহবিল বিনিয়োগে বিশেষ সতর্কতা জারি করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া প্রারম্ভিক মূলধন আর মুনাফা যোগ হওয়ার পর বর্ধিত মূলধনের মধ্যেও পার্থক্য করতে হবে। প্রারম্ভিক মূলধন নিরাপদ করতে না পারলে খুব বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীও মানসিক চাপে পড়ে যান এবং তার ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। বর্ধিত মূলধন শেয়ারবাজারে আপনাকে বর্ধিত মুনাফার জন্য বাড়তি ঝুঁকি নেয়ার শক্তি ও সাহস জোগায়। এগুলো মানি ম্যানেজমেন্টের আলোচনা। প্রারম্ভিক মানি ম্যানেজমেন্টে রক্ষণশীল না হলে বর্ধিত মূলধনের শক্তি অর্জন করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে যায়।

    বিচলতা

    শেয়ারদর নানা মত, নানা পথ, নানা কৌশলের ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠানের অ্যাকশনের প্রতিফলন। ব্যবহারিক প্রেক্ষাপট অনেক সময় তাদের অনেকের কোর্স অব অ্যাকশন পরিবর্তন করে দেয়। এগুলোই বাজারকে আপনার প্রত্যাশিত পথে এগোতে দেবে না। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি প্রতিকূলতায় বিচলিত হওয়া যাবে না। কারণ পথে পথে হোঁচট না খেয়ে কোনো শেয়ারই তার গন্তব্যে পৌঁছায় না।

    আপনি যদি বিনিয়োগকারী হন, তাহলে আপনি আপনার শেয়ারের ভ্যালু জানেন। সেকেন্ডারি বাজার কোন দিকে যাচ্ছে, তার অধ্যয়ন আপনাকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেবে। তবে সাময়িক প্রতিকূলতায় আপনি বিচলিত হবেন না।

    আর আপনি যদি ট্রেডার হন, তাহলে আপনার নিজস্ব কৌশল রয়েছে। অবশ্যই এ কৌশল হিস্টোরিক্যাল ব্যাকটেস্টিংয়ের পরীক্ষা উতরে আসতে হবে। আপনার এন্ট্রি, হোল্ডিং, এক্সিটের নিয়ম রয়েছে। মানি ম্যানেজমেন্টের সব রক্ষাকবচও আপনার রয়েছে। আপনি আরো আত্মবিশ্বাসী হওয়ার জন্য মৌলভিত্তিক বাস্তবতা, বাজারের আচরণগত অন্য বিষয়গুলো অনুধাবন করবেন।

    কিন্তু পশ্চিমের মনোবিদরা জরিপ করে জানিয়েছেন, সব কিছুর পরও ব্যক্তি শ্রেণীর বিনিয়োগকারী বা ট্রেডারদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলার প্রবণতা খুব জোরালো। সব কিছু প্রত্যাশিত পথে না এগোলে তারা বিচলিত হয়ে যান। অনেকে পরিকল্পনা থেকে মাঝপথে ছিটকে পড়েন। অনেকে আবার হতাশ হয়ে কৌশলই বদলে ফেলেন। ২০১০ সালে এক্সিটের কমন রুলগুলো প্রয়োগ করে হতাশ হয়ে একসময় নো এক্সিট নীতি আঁকড়ে ধরেছিলেন বহু বিনিয়োগকারী/ট্রেডার। নো এক্সিটের ফল খুব ভয়ানক হয়েছিল।

    স্বল্পমেয়াদি প্রতিকূলতাগুলোকে জয় করার মতো দৃঢ়তা থাকতে হবে। একটি বড় সমস্যা হলো, এ প্রতিকূলতা স্বল্পমেয়াদি না দীর্ঘমেয়াদি— এটি আমরা কীভাবে বুঝব? উত্তরে বলতে হবে, এজন্য অ্যাডভান্সড লেভেলের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে, ৩৬০ ডিগ্রি চোখে। তার পরও নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না আপনি বাজারের সবচেয়ে বড় ইভেন্টগুলো সময়মতো বুঝে যাবেন। মানবজাতির ইতিহাসে কেউই সবসময় এটি করে দেখাতে পারেননি।

    তবে নিজের নিয়মে অটল থেকে রেকর্ড মুনাফা নিয়ে বাড়ি গেছেন হাজারো বিনিয়োগকারী বা ট্রেডার। একটু কম আর বেশি, মুনাফা তো!

    প্রচলিত বহু ধারণার কার্যকারিতা আর অসারতা নিয়ে অনেক বিতর্কও দেখা যায়। শেয়ারবাজারে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে সেগুলো সম্পর্কেও একটি দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করা জরুরি

    বিনিয়োগ আসলে ধনীদের কাজ: মোটেই না। আপনি হয়তো উচ্চ সম্পদধারীর ইকোনমি অব স্কেলটি পাবেন না। তবে সমানুপাতে তার কৌশলগুলো রেপ্লিকেট করে দেখুন, ফল খারাপ হয় না।

    মার্কেট টাইমিংয়ের স্কিল অত্যাবশ্যক: ঠিক উল্টো কাজটি না করলে আর একটু ধৈর্য রাখলে টাইমিং স্কিল জরুরি না।

    বড় রিটার্ন মানেই বড় ঝুঁকি: মোটা দাগে কথাটি সত্য বলে মনে হয়। তবে প্রারম্ভিক মূলধন নিরাপদ করার পর বিষয়টি আর এ মাত্রায় সঠিক থাকে না। ছোট রিটার্নে বড় ঝুঁকির উদাহরণগুলোও আমরা দেখলাম।

    ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি: শেয়ারবাজারে সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত বিষয়গুলোর একটি। শেয়ারদর, বাজারের আচরণ, ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবেই— এমনটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে ইতিহাস বলে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তা ঘটে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে তার রূপ ও মাত্রায় রকমফের হতেই পারে।

    বয়স বাড়তে থাকলে ক্রমেই রক্ষণশীল হতে হবে: মানি ম্যানেজমেন্টের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিষয়টি পুরো উল্টো। কম বয়সে আমাদের অর্জিত মুনাফা ও মূলধন ভিত্তি তুলনামূলক দুর্বল থাকে। সে সময় লোকসান করে বাজার থেকে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। ব্যক্তিত্বেও থাকে আগ্রাসী পদক্ষেপ নেয়ার প্রবণতা। আমাদের বরং কম বয়সেই বেশি রক্ষণশীল থাকতে হবে। এতে সফল হলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অর্জিত মুনাফা, সম্পদভিত্তি, ঝুঁকি নেয়ার সক্ষমতা সবই বাড়বে। অভিজ্ঞতালব্ধ ম্যাচিউরিটি তখন আমাদের আরো ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে। বয়স বাড়ার পর আমাদের জন্য শুধু চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় মনোদৈহিক বিষয়গুলো। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে তখন আরো বেশি জোর দিতে হয়।

    বিনিয়োগ মাত্রাতিরিক্ত জটিল বিষয়: শত শত জটিল বিষয় বিশ্লেষণ করেন পেশাদার বিনিয়োগকারীরা। তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় এ প্রচেষ্টা। তবে শেয়ারবাজারে মুনাফা করার শর্ত হিসেবে জটিল সব বিশ্লেষণের চেয়ে শৃঙ্খলাকে আপনি কোনোভাবেই কম নম্বর দিতে পারবেন না।

    হার্ডওয়ার্ক: বিনিয়োগ বা ট্রেডিং কঠোর পরিশ্রমের বিষয় নয়, আবার অলস মানুষেরও কাজ নয়। ক্রীড়া প্রশিক্ষকরা বলেন, প্র্যাকটিসে হার্ডওয়ার্ক করুন। ম্যাচে নির্ভার থাকুন। ওয়াল স্ট্রিটের প্রশিক্ষকরা বলেন, প্রস্তুতি নিন কঠোরভাবে। নিজেকে হালনাগাদ রাখতে পড়াশোনা করুন। আর বিনিয়োগের মাঠে থাকুন দুশ্চিন্তামুক্ত। কারণ এ বাজারের সব মুনাফা আপনার জন্য না। আবার যেটুকু মুনাফা এ বাজার থেকে পাওয়া সম্ভব, সেটি অন্য যেকোনো বিকল্পের চেয়ে বেশি।