ঢাকায় চলবে পাতাল রেল

    বিএম ডেস্ক: রাজধানীর যানজট নিরসনে আরও দুটি মেট্রোরেল নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। এই দুটিতে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে পাতাল রেল। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম।

    প্রথম পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) ভিত্তিতে ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ টঙ্গী ও আমিনবাজার থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় রুট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ রুট দুটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় হতে পারে প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

    ২০২৭ সালের মধ্যে আরও দুই মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা ২০২০ সালে শেষ হবে উত্তরা-মতিঝিল রুটের কাজ ৫টি মেট্রোরেলের মধ্যে তিনটির অর্ধেকের বেশি হবে পাতাল রেল টানেল ও স্টেশনের মাটি নিয়ে জট

    ২০২৭ সালের মধ্যে এ দুটি চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানী লিমিটেড। নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের পাশাপাশি এমআরটি লাইন-১ ও এমআরটি লাইন-৫-এর নর্দান রুট বা উত্তরাংশ শীর্ষক মেট্রোরেল দুটি নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯১ হাজার কোটি টাকা। এ দুই প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দেবে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। এছাড়া মেট্রোরেল দুটির সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়নেও সহায়তা করছে সংস্থাটি।

    সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, পাঁচটি মেট্রোরেলের মধ্যে তিনটির অর্ধেক বা তারও বেশি হবে পাতাল রেল। এর মধ্যে ২০২৬ সালে শেষ হবে দ্বিতীয়টি তথা এমআরটি লাইন-১। এর দুটি অংশ রয়েছে। একটি অংশ বিমানবন্দর থেকে খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত যাবে। এ অংশের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে মাটির নিচ দিয়ে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম পাতাল রেল। বাকি তিন দশমিক ৬৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে (এলিভেটেড)। এ অংশে ১২টি স্টেশন থাকবে, যার সবগুলোই হবে মাটির নিচে।

    এমআরটি লাইন-১-এর দ্বিতীয় অংশটি নতুনবাজার থেকে যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা, পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি, মস্তুল, পূর্বাচল পশ্চিম, পূর্বাচল সেন্টার হয়ে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত যাবে। এ রুটের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৭ কিলোমিটার, যার পুরোটাই উড়ালপথে। এ রুটে স্টেশন সংখ্যা ৯টি। এর মধ্যে নতুনবাজার স্টেশনে ইন্টারচেঞ্জ থাকবে। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে বিমানবন্দর রুট থেকে পূর্বাচল রুটে ও পূর্বাচল রুট থেকে বিমানবন্দর রুটে যেতে পারবেন যাত্রীরা।

    দুই অংশ মিলিয়ে ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত ৯ ডিসেম্বর মেট্রোরেলটির বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন শুরু হয়েছে।

    এদিকে, রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল বা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬-এর নির্মাণকাজ চলছে। আগামী বছর এটির নির্মাণকাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

    জানা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন রুটে প্রস্তাবিত পাঁচটি মেট্রোরেলের নির্মাণ অগ্রগতি পর্যালোচনায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে জানানো হয়, তিন ধাপে ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২০২০ সালের মধ্যে নির্মাণ শেষ করা হবে উত্তরা-মতিঝিল রুটের মেট্রোরেল। দ্বিতীয় ধাপে একটি মেট্রোরেলের পূর্ণাঙ্গ ও আরেকটি আংশিক এবং তৃতীয় ধাপে বাকিগুলোর নির্মাণ শেষ হবে।

    সূত্র জানায়, ঢাকায় তৃতীয় মেট্রোরেল তথা এমআরটি লাইন-৫-এর নর্দান রুটের দৈর্ঘ্য হবে ১৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬০ কিলোমিটার মাটির নিচ দিয়ে (পাতাল রেল) ও বাকি ৬ কিলোমিটার উড়ালপথে হবে। এ মেট্রোরেলটি সাভারের হেমায়েতপুর থেকে বলিয়ারপুর, মধুমতি, আমিনবাজার, গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান-২, নতুনবাজার হয়ে ভাটারা যাবে। এ রুটে ১৪টি স্টেশন থাকবে, যার ৯টি মাটির নিচে ও পাঁচটি উড়ালপথে হবে। এমআরটি লাইন-৫-এর নর্দান রুটটির নির্মাণকাজ ২০২৭ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা।

    অন্যদিকে, এমআরটি লাইন-৫-এর সাউদার্ন রুট তথা দক্ষিণাংশ নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সাল। এ অংশটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ কিলোমিটার, যার উড়ালপথ ও মাটির নিচ মিলিয়ে নির্মাণ করা হবে। এ অংশে মেট্রোরেলটি গাবতলী থেকে টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদ গেট, রাসেল স্কয়ার, পান্থপথ, সোনারগাঁও হোটেল, হাতিরঝিল, নিকেতন, রামপুরা, আফতাবনগর পশ্চিম, আফতাবনগর সেন্টার, আফতাবনগর পূর্ব হয়ে দাশিরকান্দি পর্যন্ত যাবে। এ রুটে ১৭টি স্টেশন থাকবে। এরই মধ্যে এমআরটি লাইন-৫-এর সাউদার্ন রুটের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়েছে।

    সূত্র জানায়, ঢাকা ও আশেপাশের এলাকার জন্য আরও দুটি মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে এমআরটি লাইন-৪ নির্মাণ করা হবে কমলামপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিদ্যমান রেলপথের নিচ দিয়ে। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেলের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে উন্নয়ন সহযোগী অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

    এছাড়া গাবতলী থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত এমআরটি লাইন-২ নির্মাণ করা হবে জিটুজি ভিত্তিতে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) পদ্ধতিতে মেট্রোরেলটি নির্মাণে জাপান ও বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে সহযোগিতা স্মারক সই করেছে। প্রায় ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেলের সম্ভাব্য যাচাইয়ে প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছে।

    এর আগে ২০১২ সালে নেওয়া হয় এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণ প্রকল্পটি। বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন শেষে ২০১৬ সালে এর মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাইকা। মেট্রোরেলটির উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও অংশের দেড় কিলোমিটার ভায়াডাক্ট (উড়ালপথ) নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি অংশের নির্মাণকাজও চলছে। এছাড়া চলতি বছরে জুনে উত্তরায় এর ডিপো নির্মাণ শেষ হবে।

    প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মেট্রোরেলটির ট্র্যাক (রেলপথ) জুলাইয়ে দেশে আসতে শুরু করবে। আর রোলিং স্টকের (ইঞ্জিন-কোচ) নির্মাণকাজও শুরু হয়ে গেছে। লাল সবুজ রঙে ডিজাইন করা হয়েছে মেট্রোরেলের। চলতি বছরের শেষের দিকে এগুলো দেশে আনা হবে।

    টানেল ও স্টেশনের মাটি নিয়ে জটিলতা:
    এদিকে, ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় মাটি ফেলার জায়গা না পেয়ে জটিলতার মুখে পড়েছে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। ঢাকার বিভিন্ন রুটে প্রস্তাবিত পাঁচটি মেট্রোরেলের নির্মাণ অগ্রগতি পর্যালোচনা বৈঠকে বিষয়টি উঠে আসে। এতে জানানো হয়, ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল (পাতাল) নির্মাণে সবচেয়ে জটিলতা হবে মাটি অপসারণ ও তার ব্যবহার নিয়ে।

    সংশ্লিষ্ট তথ্যমতে, ঢাকায় পাতাল রেল হবে সড়কের ১৫০ থেকে ২০০ ফুট নিচে। আর স্টেশনগুলোর আকার হবে কয়েক হাজার বর্গফুট ও তিন-চার তলাবিশিষ্ট। এতে পাতাল রেলের টানেল ও স্টেশন থেকে প্রচুর মাটি অপসারণ করতে হবে। ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় এত পরিমাণ মাটি ফেলার মতো পর্যাপ্ত নিচু জমি নেই। কিছু স্থানে নিচুজমি বা খাল থাকলেও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সেখানে মাটি ফেলা সম্ভব নয়। তাই মেট্রোরেলের মাটি ফেলার জন্য একাধিক বিকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

    প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার জন্য প্রস্তাবিত পাতাল রেলের মাটি অপসারণ ও তা ফেলতে যে ব্যয় হবে, তা দিয়ে উড়ালপথে আরেকটি মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব। পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষও। তাই কম ব্যয়ে ও সাশ্রয়ী সময়ে কীভাবে মাটি অপসারণ করা যায়-তা নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট সব মহলের মতামত চাওয়া হয় বৈঠকে। এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণও বিবেচনা করা হচ্ছে।

    এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মাটি ফেলার জন্য সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের জন্য নিচু জমি ভরাটে প্রচুর বালি ও মাটি দরকার হবে। এক্ষেত্রে আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেলের মাটি সরবরাহ করা যায় কি না, তা বিবেচনা করা হচ্ছে। এজন্য আবাসন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

    বিএম/রনী/রাজীব