প্রথম বিয়ের তথ্য গোপন,একাধিক সম্পর্কের তথ্য ফাঁস : ক্ষোভ থেকেই স্বামীকে হত্যা করে আশা

    চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচনে পুরস্কৃত পুলিশ : আদালতে আশার জবানবন্ধী

    রাজীব সেন প্রিন্স : চট্টগ্রামে চারদিন আগে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী থানার আব্দুল আলী নগর নেছারিয়া মাদ্রাসা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় খুন হন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শ্যামন্তগড় এলাকার আবু কালামের ছেলে মো. শামীম। খুন হওয়ার দিনই বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল বাবুর্চির পেশায় কর্মরত নিহত শামীম। তাকে গলা কেটে খুন করেছে বগুড়া জেলার সদর উপজেলার ঠনঠনিয়া নতুন পাড়ার আব্দুল আজিজের মেয়ে ও শামীমের স্ত্রী মোছাম্মৎ আশা আক্তার।

    প্রথম স্ত্রী সন্তানের কথা গোপন এবং একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় মনের ক্ষোভ থেকেই শামীমকে গলাকেটে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার কথা পুলিশের কাছে অকপটে স্বীকার করেছে খুনী মোছাম্মৎ আশা আক্তার।

    চারদিন আগের নৃশংস এ হত্যাকান্ডের তদন্তে নেমে একটি মোবাইল ফোনকলের সূত্র ধরে পাহাড়তলী থানা পুলিশ প্রথমে নিহতের পরিচয় নিশ্চিত করে। এবং পরে ঘনিষ্টজনদের দেয়া বিভিন্ন তথ্য নিয়ে খুনী আশা আক্তারকে বগুড়া থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর বুধবার সকালে তাকে আনা হয় চট্টগ্রাম।

    দুপুরে সিএমপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতার আশা খুনের স্বীকারোক্তি গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) কুসুম দেওয়ান।

    কুসুম দেওয়ান বলেন, এ হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত চাকুটি ছাড়া আর তেমন কোন ক্লু ছিলোনা। শামীমের ব্যবহৃত মোবাইল সেটটিও পাওয়া যায়নি ঘটনাস্থলে, সেটিও বগুরা নিয়ে গেছিলো খুনী আশা আক্তার। তবে যেদিন শামীম খুন হয় তার আগের দিন ওই বাসার জমিদারের মেয়ে তানিয়ার মোবাইলে একটি কল আসে বাসাটি ভাড়ার জন্য। শুধুমাত্র ওই ফোন কলের সূত্র ধরে নিহতের যাবতীয় পরিচয় ও খুনীর অবস্থান নির্ণয় অতঃপর বগুরা কর্মস্থল থেকে মঙ্গলবার আশাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

    গ্রেফতারের পর আশার স্বীকারোক্তির বরাতে কুসুম দেওয়ান বলেন, শামীম পেশায় বাবুর্চি ছিলেন, বাড়ি তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলেও তার মা, এক বোন, প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে খুলশী থানার ডেবারপাড় এলাকায় বাসা ভাড়া করে বসবাস করতেন।

    বছরখানেক আগে ফেসবুকের মাধ্যমে শামীমের পরিচয় হয় আশার সাথে।

    গত চারমাস আগে আশার পরিবারের সম্মতিক্রমে বিয়ে হয় শামীমের সাথে। বিয়ের পর বগুরাতে একটি বাসা ভাড়া নিয়েই থাকত দুজন।

    বিয়ের কিছুদিন পর আশা জানতে পারে শামীম বিবাহিত। তাছাড়া শামীম একাধিক মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গ ছবি এবং ফেসবুকে একাধিক জনের সাথে সম্পর্কের বিষয়টাও ধরা পড়ে আশার হাতে।

    কুসুম দেওয়ান সংবাদ সম্মেলনে আরো বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আশা তাদের জানিয়েছে, এতকিছু জানার পরও আশা শামীমকে শুধুমাত্র এককভাবে পেতে বগুড়া থাকার জন্য এনজিও থেকে ৬৫ হাজার টাকা ঋণ করে একটি ইজি বাইকও কিনে দিয়েছিল শামীমকে। কিন্তু বাইকটি তিনদিন চালানোর পর সে আশাকে না জানিয়ে চলে আসে চট্টগ্রাম।

    এরপর আশা শামীমের সাথে যোগাযোগ করলে সে ইজি বাইক না চালানোর কথা বলেন। তাতেও কিছু মনে করেনি আশা। শামীমের জন্য ফের চাকরি ঠিক করে তাকে ফোনে জানায়। এসময় শামীম আশাকে ইজি বাইকটি বিক্রি করে একেবারে চট্টগ্রাম চলে আসতে বলেন। এতে চরম ক্ষুদ্ধ হয় আশা। মূলত আগের স্ত্রীর তথ্য গোপন ও একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্ক থাকার রাগে ক্ষোভে পরিকল্পনা করেই আশা শামীমকে গলা কেটে হত্যা করে।

    পাহাড়তলী থানার ওসি সদীপ দাশ বলেন, বগুড়া শহরে একটি বায়িং হাউজে চাকরির পাশাপাশি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট থেকে আশা এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। চাকরি ও পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হয় শামীমের সাথে। সম্পর্ক গড়াই বিয়ে পর্যন্ত। তবে বিয়ের আগ পর্যন্ত আশার পরিবারের কেউই জানতো না শামীম বিবাহিত।

    তাছাড়া দুই স্ত্রী থাকা স্বর্ত্তেও শামীমের মোবাইলে তার সাথে একাধিক নারীর সাথে অন্তরঙ্গ ছবি দেখতে পাই আশা। এসব জানার পর প্রতারণার স্বীকার হয়ে রাগ ও ক্ষোভে শামীমকে একাই খুন করেছে বলে পুলিশকে জানিয়েছে আশা আক্তার।

    খুনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, খুনের ঘটনা সংঘঠিত হওয়ার কিছুদিন আগে আশাকে চট্টগ্রামে আসার প্রস্তাব দেয় শামীম। খুনের পরিকল্পনা নিয়েই আশা তাতে রাজি হন। আশার দাবী যাকে হাজার চেষ্টা করেও এত ত্যাগ স্বীকার করেও অর্থ ব্যয় করেও এককভাবে পাওয়া হবে না তাকে দুনিয়াতেই সে রাখবে না।

    এ চিন্তা থেকে বগুড়ার একটি বাজারে গিয়ে ধারালো ছুরি কিনে ব্যাগে নিয়ে মাকে বান্ধবীর কাছ থেকে প্রাকটিকেল খাতা দেখানোর নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আশা। ঢাকা হয়ে চলে আসে চট্টগ্রামে শামীমের ভাড়া করা সে বাসায়। তবে এর আগে আশাকে যাতে কেউ খুজে না পাই সেজন্য তার মোবাইল ও সিম নষ্ট করে ফেলে সে নিজেই। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে চট্টগ্রাম নগরীতে পৌঁছে পাহাড়তলীর ভাড়া বাসায় ওঠে।

    প্রতারিত হওয়ার ক্ষোভ থেকে শামীমকে ঘুমন্ত অবস্থায় মুখের পর লাল কম্বল চেপে ধরে গলায় ছুরি চালিয়ে খুন করে আশা। এরপর তার স্বামীর নিথর দেহ দেখে কিছুক্ষণ বসে থাকে পাশে। পরে আরেকটি চাদর মুখে দিয়ে আরো বেশ কয়েকবার ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে রক্তমাখা জামা পাল্টে পালিয়ে যায় বগুড়ায়।

    ওসি বলেন, তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে খুনের চারদিন পর সূত্রবিহীন চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার রহস্যও উন্মোচন হয়। মঙ্গলবার বগুড়ায় আশার কর্মস্থল থেকে তাকে গ্রেফতার করে বুধবার সকালে চট্টগ্রাম আনা হয়।

    বুধবার বিকেলে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালতে আশা আক্তারকে হাজির করলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন আশা। আদালতের কাছেও সে জানিয়েছে ভালবেসে বিয়ে করে প্রতারিত হয়ে রাগ ও ক্ষোভ থেকে একাই সে স্বামী মো. শামীমকে গলাকেটে হত্যা করে।

    সংবাদ সম্মেলনে সিএমপির উপ-কমিশনার (পশ্চিম) ফারুক উল হক, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কামরুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী কমিশনার (পাহাড়তলী জোন) পংকজ বড়ুয়া, পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সদীপ কুমার দাশ উপস্থিত ছিলেন। আরো : চট্টগ্রামে ঘর ভাড়া নিয়ে বাসায় ঢুকে লাশ হলেন স্বামী,পলাতক স্ত্রী

    এদিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে খুনের রহস্য উদঘাটন ও হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আসামীকে গ্রেফতারে সক্ষম হওয়ায় এ ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত সকল পুলিশ কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানান এবং পাহাড়তলী থানাকে পুরস্কৃত করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান।

    জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এ খুনের রহস্য উদঘাটনে সার্বিক নির্দেশনা ছিলো উপ-পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) মো. ফারুক উল হক। বিভিন্ন ভাবে নের্তৃত্ব দিয়েছেন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) মোঃ কামরুল ইসলাম, সহকারী পুলিশ কমিশনার (পাহাড়তলী) পংকজ বড়ুয়া ও পাহাড়তলী থানার অফিসার ইনচার্জ সদীপ কুমার দাশ।

    চাঞ্চল্যকর খুনের নানা তথ্য অনুসন্ধান ও আসামি গ্রেফতারে ভুমিকা রেখেছে পাহাড়তলী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল্লাহ আল হারুন, এসআই মো. কাইছার হামিদ, এসআই রানা প্রতাপ বনিক, এসআই অর্নব বড়–য়া, এসআই ত্রিরতন বড়–য়া, এএসআই মিটু দাশ, এএসআই শাকিল সেন, এএসআই মো. আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া, এএসআই মোছাঃ রোকসানা আক্তার ও সঙ্গীয় অফিসার ফোর্স। সকলের দৃঢ় প্রচেষ্ঠায় খুব কম সময়ের মধ্যে আসামীকে সনাক্ত করে গ্রেফতার এবং হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও আসামীর সাথে থাকা রক্তমাখা জামাকাপড় উদ্ধার করা হয়।

    বিএম/রাজীব সেন…