নানা নাটকীয়তায় মিতু হত্যাকান্ডের পাঁচ বছর

    রানা নাহা , বাংলাদেশ মেইল ::

    চট্টগ্রামের আলোচিত মিতু হত্যাকান্ডের ৫ বছর পূর্ণ হলো আজ । গেল ৫ বছরে হত্যাকান্ডের রহস্য উম্মোচিত না হলেও তদন্তে এসেছে নানা নাটকীয়তা । ২০১৬ সালের ৫ই জুন চট্টগ্রামের জিইসি মোড় এলাকায় দূর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতারের স্ত্রী ।

    আজকের এই দিনে জিইসি এলাকায় ছেলেকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিতে গিয়ে নিজ বাসার একশো গজের মধ্যেই খুন হন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতু । আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রীর খুনকে শুরুতে জঙ্গিদের প্রতিশোধ হিসেবে বিবেচনায় আনা হলেও শেষ পর্যন্ত বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় এমন হত্যাকান্ড সে বিষয়ে নিশ্চিত হয় পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারা । শুরুতে স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে থানায় মামলা করেছিলেন বাবুল; সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ই তিনি এখন প্রধান আসামি হয়ে গেলেন রিমান্ডেও।

    নানা হাত ঘুরে মামলার তদন্তের ভার পৌছায় পিবিআই’র কাছে । পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে তিনিই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের নায়ক এবং নীল নকশাকারী। বাদী থেকে শেষ পর্যন্ত বাবুল আক্তারকেই করা হয়েছে স্ত্রী হত্যার আসামি। বাবুল আক্তারের শশুরের পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা নতুন মামলায় শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার দেখানো হয় তাকে । গ্রেপ্তারের পর ব্রিফিং করে গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে— ভাড়াটিয়া খুনি চক্র দিয়ে বাবুল আক্তারই  স্ত্রীকে হত্যা করিয়েছেন। গণমাধ্যমে উঠে এসেছে সাবেক এসপি বাবুলের সাথে ইউএনএইচআরে কর্মকর্তা গায়েত্রীর পরকীয়া কাণ্ড। এরপর পাঁচ দিনের রিমান্ড, রিমান্ড শেষে আদালতে সেখান থেকে চট্টগ্রাম কারাগার হয়ে বর্তমানে তার জায়গা হয়েছে ফেনী কারাগারে। একসময়ের চৌকস এই পুলিশ কর্মকর্তা এখন ফেনী কারাগারে কারাবন্দী।

    ২০১৬ সালের ৬ ই জুন মিতু হত্যাকান্ডের একদিন পরেই পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের আসামী করে দায়ের করা হয়েছিল প্রথম মামলা । বাবুল আক্তার নিজে বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেছিলেন । পরে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি মোটর সাইকেল আটক করার পর মোড় নেয় মামলা তদন্ত ।

    শুরুতে জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও ২৬ জুন মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম ও আনোয়ার নামের  দুজন গ্রেফতারের পর এবং ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, খুনিরা ‘পেশাদার অপরাধী’।

    পাঁচলাইশ থানা পুলিশ মামলাটির তদন্ত শুরু করলেও তদন্ত শুরু দু’দিনের মধ্যেই চট্টগ্রাম সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয় মামলাটি। দীর্ঘদিনের তদন্তে বাবুল আক্তার ও তার শ্বশুর-শাশুড়িকে কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা ।

    মামলার তদন্ত চলাকালীন সময়ে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তার চাকরী থেকে স্বেচ্চায় অব্যাহতি আবেদন করেন আইজিপি বরাবর । যদিও পরবর্তিতে নিজে থেকে চাকরী ছাড়ার কথা অস্বীকার করেন পুলিশের সাবেক এই এসপি ।

                    হত্যাকান্ডের আগের কথা 

    ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামে খুন হন মিতু। তার ছয় দিন আগে এক ফেইসবুক পোস্টে চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনের সময় কারও ‘বিরাগভাজন’ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বাবুল। ওই পোস্ট দেওয়ার দুদিন পর পুলিশ সুপার হয়ে ঢাকায় পুলিশ সদরের নতুন কর্মস্থলে যোগ দেন বাবুল। তার মধ্যেই প্রকাশ্যে সড়কে খুন হন মিতু। চট্টগ্রামে ফিরে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে নিজেই বাদি হয়ে হত্যা মামলা করেছিলেন পাঁচলাইশ থানায়। স্ত্রী হত্যায় জঙ্গিদের দিকেও ইঙ্গিত করেন জঙ্গিবিরোধী বহু অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বাবুল।

    যেভাবে সন্দেহের তালিকায় যুক্ত হয়েছিলেন বাবুল আকতার :

    মামলার তদন্ত চলাকালীন সময়ে বাবুল আক্তারের কাছে বিভিন্ন পারিবারিক ও পেশাগত তথ্য জানতে চান তদন্ত কর্মকর্তারা । সিসিটিভির ফুটেজে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত একজনের পরিচয় নিশ্চিত হবার পরই মোড় মামলার তদন্ত । জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবুল আক্তারকে ঢাকায় ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে নেয়া হয় । ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছিল পুলিশ। যাদের মধ্যে ছিলেন বাবুলের ‘সোর্স’ কামরুল ইসলাম শিকদার মুছাও। কিন্তু তখন তাকে ‘চিনতেই পারেননি’ বাবুল। এরপর সেই মাসেই ঢাকার গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাবুলকে। এরপর নানা নাটকীয়তার পর চাকরি থেকে তার অব্যাহতির আবেদন মঞ্জুর করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

    সুত্রমতে ,তখন ডিবি কার্যালয়ে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের দুজনকে মুখোমুখি করানো হয়েছিল বাবুল আক্তারকে । যাদের একজন বাবুল আক্তারের ঘনিষ্ট সোর্স । কিন্তু তখন বাবুল তাকে চেনেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন । এরপর থেকে মামলার তদন্ত সন্দেহভাজন হিসেবে যুক্ত হয় বাবুল আক্তারের নামও ।  শুরু থেকে চট্টগ্রামের ডিবি পুলিশ মামলাটির তদন্ত করে। তারা প্রায় তিন বছর তদন্ত করেও অভিযোগপত্র দিতে ব্যর্থ হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালত মামলাটির তদন্তের ভার পিবিআইকে দেয়া হয় ।

         পিবিআই’র তদন্তে হত্যাকাণ্ডের কারণ:

    ২০১৪ সালে কক্সবাজারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে যোগ দেওয়ার পর গায়ত্রী অমর সিং নামের এনজিও কর্মকর্তার সম্পর্ক ও পরকিয়ার জেরে মিতু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে-এমনটাই গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে পিবিআই’র পক্ষ থেকে । গায়ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক প্রেমের বিষয়টি প্রথমে মিতু আঁচ করতে পারলেও পরে গায়ত্রীর দেয়া দু’টি বই এবং বইতে থাকা কিছু লেখা থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হন তিনি। এসব নিয়ে ঝগড়া-বিবাদের পাশাপাশি মিতুকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতনের পাশাপাশি বাবুল আক্তার মিতুকে ডিভোর্স দেয়ারও হুমকি দেন। কিন্তু তার সব অপকর্ম প্রকাশ্যে জানিয়ে দেবেন বলে মিতু উল্টো হুমকি দিলে বাবুল মিতুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেন বলে দাবি মিতুর বাবার।

    ঘটনার ৫ বছর পরমিতু হত্যাকাণ্ডে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে সর্বশেষ গত ১২ মে মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন পাঁচলাইশ থানায় এজাহার দায়ের করেন। এজাহারে সাবেক এসপি ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার, কিলিং স্কোয়াডের সদস্য মো. কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুছা, এহতেশামুল হক ওরফে ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খায়রুল ইসলাম ওরফে কালু, ওরফে কসাই কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার ওরফে সাকু মাইজ্যা ও শাহজাহান মিয়াকে আসামি করা হয়েছে। যদিও এদের মধ্যে দু’জন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন এবং বর্তমানে জেলে আছে দু’জন। তবে পুলিশের মতে নিখোঁজ রয়েছেন কিলিং স্কোয়াডের নেতৃত্বদানকারী মুছা।

                        যে সব প্রশ্নের উত্তর নেই 

    মিতু হত্যাকান্ডের আগে বাবুল আকতারের দেয়া ফেসবুক স্টাটাসে তিনি কার বিরাগভাজন হবার আশংক প্রকাশ করেছিলেন ? পুলিশ ও সিআইডি’র তদন্ত শেষ হবার আগেই বাবুল আক্তারকে চাকুরী থেকে অব্যাহতির সুযোগ দেয়ার কারণ কি ? হত্যাকান্ডে বাবুল আকতার জড়িত এবিষয়ে নিশ্চিত হবার পরও মামলার তদন্তে কালক্ষেপন জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের । এছাড়া হত্যাকান্ডের মুল নেতৃত্ব দেয়া মুছাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে এমন অভিযোগ করেছিলেন মুছার স্ত্রী । ৫ বছরেও তার হদিস পাইনি পুলিশ কিংবা মুছার পরিবার । গেল ৩১ মে  মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন । চট্টগ্রামে আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় ‘পলাতক’ আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। পান্না আক্তার সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার সঙ্গে তার স্বামী মুছার সম্পৃক্তার বিষয়ে স্বীকার করেছেন । যদিও এর আগে পান্না আক্তার মুছার হদিস চেয়ে ভিন্ন দাবি করেছিলেন ।