ষোল জনের মৃত্যু
ত্রুটিপূর্ণ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ‘বিএম ডিপো’র

বাংলাদেশ মেইল ::

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো ‘বিএম ‘ আলোচনায় আসলেও অধিকাংশ কনটেইনার ডিপোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। শনিবার  (৪ জুন) রাত নয়টা থেকে টানা আট ঘন্টা আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে অঙ্গার হয়েছে অন্তত নয়জন শ্রমিক।

সরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা ষোলজন।স্থানীয়দের বর্ণনা অনুযায়ী লাশের সংখ্যা ছাড়াবে ২০। তিন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু হয়েছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে গিয়ে।  অগ্নিদগ্ধদের অনেকেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। আহতদের সংখ্যাও ছাড়িয়েছে তিনশো।

প্রাথমিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের সুত্রপাত কেমিক্যাল বহন করা কনটেইনার থেকে বলা হলেও, বিএম কনটেইনার ডিপোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটির কথা জানা যায় প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত কর্মচারীদের কাছে।

ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘ কনটেইনারে আমদানি করা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিলো। ফলে কনটেইনার দ্রুত বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ‘

বিএম কনটেইনার ডিপো (বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোট আইসিডি) স্মাট গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ২০১১ সালে নেদারল্যান্ডস -বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে চালু করা হয়েছিলো বেসরকারি এই কনটেইনার ডিপোটি। আইসিডি নীতিমালা অনুযায়ী  আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার  শর্ত থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি তার অনেকটাই মানে নি।

দূর্ঘটনার সময় ডিপোতে  অবস্থান করা ট্রাক শ্রমিক মাহমুদ বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ক্যাজুয়াল নন ক্যাজুয়াল তিনশোর অধিক শ্রমিক রয়েছে। এসব শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। ভেতরে অবস্থান করা ট্রাক শ্রমিকদের জন্যও কোন নির্দেশনা ছিলো না। ‘

সোহেল নামের আরেক শ্রমিক জানান, ‘ ডিপোর ভেতরে পানি সঞ্চালন লাইনেও ত্রুটি রয়েছে। আগুন লাগার সাথে সাথে তাৎক্ষণিকভাবে পানি সংগ্রহ করতে সময় লেগেছে বেশি। ‘

চমেক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নুরুল আমিন নামের আরেক শ্রমিক জানান,  কনটেইনারগুলো একটা উপর একটা রাখার সিস্টেম প্রচলিত আছে। কিন্তু জায়গা ফাঁকা না থাকার কারনে ৪/৫ টি কনটেইনারকে উপুর্যুপরি রাখা হয়েছে। আগুন ও বিস্ফোরণের শব্দে ভীত হয়ে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আমার পা ভেঙ্গে গেছে। ‘

আইসিডিতে কী পরিমাণ যন্ত্রপাতি থাকতে হবে, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরে শর্তাবলি নির্ধারণ করা রয়েছে। এসব শর্ত না মানলে লাইসেন্স স্থগিত রাখারও সুপারিশ করেছিলো নীতিমালা প্রণয়ন কমিটি। তবে নীতিমালা তৈরির পাঁচ বছর পরও তা বাস্তবায়নে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো উদ্যোগ। ‘বিএম’ কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সেটি স্পস্ট হয়েছে৷ আইসিডির ‘লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নে’ কাস্টম কর্তৃপক্ষ এবং ‘অনাপত্তি সনদ’ প্রদানে বন্দর কর্তৃপক্ষ দায়িত্বশীল থাকলেও এটির মান উন্নয়নে যথাযথ নজরদারি নেই তাদেরও।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নি নির্বাপণের জন্য ব্যবহৃত ‘ ফায়ার ডিস্টিনগুইসারের’ মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে। আন্তর্জাতিক মানের সেবাদানকারী হিসেবে দাবি করা প্রতিষ্ঠানটি সেইফটি ম্যানুয়াল অনুসরন করে এমন কোন নথি পাওয়া যায় নি। ‘

সুত্রমতে, নিরাপত্তা ও যন্ত্রপাতির শর্ত পূরণ না করার  কারনে ২০১৭ সালে ‘ বিএম কনটেইনার ডিপো ‘র লাইসেন্স  নবায়ন বন্ধ রেখেছিল  কাস্টম কর্তৃপক্ষ। পরে নবায়নের সুযোগ পেলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হয়নি।

বিএম কন্টেইনার ডিপোর পরিচালক মুজিবুর রহমান বলেন, কি কারনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে আমরা এখনো নিশ্চিত নই। তবে কন্টেইনার থেকেই আগুন ধরেছে বলে ধারনা করছি। নৈতিকতা ও মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে আমরা হতাহতদের পাশে থাকবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আহতরা যাতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা পায় সে ব্যবস্থা করবো। চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার আমরা বহন করবো। এ দুর্ঘটনায় যারাই হতাহত হয়েছে তাদেরকে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরন দেয়া হবে। পাশাপাশি সকল হতাহতের পরিবারের দায়িত্ব নেয়া হবে।

১৯ টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপো রয়েছে দেশে। রাজস্ব বোর্ডের নিয়মানুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩৮ ধরনের আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার এসব ডিপোতে এনে খালাস বাধ্যতামূলক। আবার বন্দরে এখন কোনো রপ্তানি পণ্য কনটেইনারে বোঝাই হয় না। রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ কারখানা থেকে এসব ডিপোতে এনে কনটেইনারে বোঝাই করে বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়।

১৯৮৪ সালে সি ফেয়ারার্স লিমিটেড নামে আইসিডি চালুর মাধ্যমে দেশে বেসরকারি আইসিডির যাত্রা শুরু হয়। এরপর কোনো নীতিমালা ছাড়াই ২০২১ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে ১৯টি বেসরকারি আইসিডি। ২০১৬ সালে অফডক নীতিমালা অনুযায়ী, বন্দরের ২০ কিলোমিটারের বাইরে অফডক স্থাপনের নির্দেশনা রয়েছে। ১৯ টি বেসরকারি আইসিডিতে শতভাগ রপ্তানি পণ্য কন্টেইনার বোঝাই করে জাহাজীকরণের জন্য বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া খাদ্য পণ্যসহ ৩৮ ধরনের আমদনি পণ্য জাহাজ থেকে বন্দরে নামানোর জন্য সেগুলো ডিপোতে এনে খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১ থেকে ২৬ কিলোমিটারের মধ্যে এসব আইসিডির অবস্থান।

পিএসএস (Port skills and safety policy) গাইডলাইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরন করে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করার কথা বলা হলেও দেশের কোন আইসিডিতেই মানা হয়না এসব নীতিমালা। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সেইফটি ম্যানুয়াল, হ্যাজাড মার্কিংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা রয়েছে পিএসএস নীতিমালায়। কিন্তু দেশের বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো এসব নির্দেশনা অনুসুরন করে না।