হার্ভার্ডের দুই গবেষকের মতামত
বিস্ফোরণে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নয়, ভুল তথ্যে আড়াল হচ্ছে নেপথ্যকারণ

বাংলাদেশ মেইল ::

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং সাইনটিস্ট হিসেবে কর্মরত প্রখ্যাত গবেষক ড. আবু আলী ইবনে সিনার মতে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ধরন ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের নাশকতার প্রচেষ্টাও হতে পারে। এমন ধারনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ‘

পৃথিবীর বিখ্যাত দুই ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ডানা ফারবার ক্যান্সার ইনস্টিটিউট এবং কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি হার্বার্ট আরভিন কম্প্রিহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টারে কর্মরত আবু আলী ইবনে সিনা প্রতিবেদককে বলেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইডকে প্রাথমিক ভাবে বিস্ফোরণের সুচনার জন্য চিহিৃত করা হলেও – বিষয়টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখা খুবই দূর্বল। আমি হার্ভার্ডের ল্যাবরেটরিতে কর্মরত বেশ কিছু গবেষকদের সাথে আলাপ করেও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তার এমন বক্তব্যের  যৌক্তিকতা খুঁজে  পাই নি।

‘ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কোন জৈব কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসলে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, নতুবা নয়। ‘ যোগ করেন ড. আলী সিনা। ‘

কনটেইনারে কেমন কেমিক্যাল থাকলে এহেন ভয়ানক বিষ্ফোরন ঘটতে পারে- এই প্রশ্নের উত্তরে ডঃ সিনা বলেন,  ‘ কনটেইনারে  হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের  বদলে যদি জৈব পার অক্সাইড (organic peroxide) থাকে তাহলে বড় বিস্ফোরণ হতে পারে। মুলত জৈব পার অক্সাইড বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।  বিশেষ করে আন্তর্জাতিক  সন্ত্রাসী বা টেরোরিস্টরা জৈব পার অক্সাইড ব্যবহার করে বিস্ফোরক তৈরিতে।  ২০০৯ সালে নিউইয়র্ক শহরের সাবওয়ে ট্রেনে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টায় জৈব পার অক্সাইড ব্যবহারের অভিযোগ আছে। ‘

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই গবেষক জানান, কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডের সুত্রপাত ও থেমে থেমে বিস্ফোরণের ঘটনা, দীর্ঘস্থায়ী আগুন, আহতদের ধরন নিরীক্ষা  -এমন ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে হয়তো বিষয়টি পরিকল্পিত  নাশকতার প্রচেষ্টা কিনা বুঝা যাবে।

ড. আলী সিনা আরো জানান, হাইড্রোজেন পারক্সাইড হল এক ধরনের জীবাণুনাশক যা  অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল কার্যকলাপসহ একটি পারক্সাইড এবং অক্সিডাইজিং এজেন্ট। ধুয়ে ফেলা এবং গার্গলিং বা সাময়িক প্রয়োগের পরে, হাইড্রোজেন পারক্সাইড তার অক্সিডাইজিং কার্যক্ষমতা  প্রয়োগ করে। একই সাথে  ফ্রি র্যাডিকেল তৈরি করে যা প্রোটিন এবং ঝিল্লি লিপিডের অক্সিডেটিভ ক্ষতির দিকে পরিচালিত করে। এটি প্যাথোজেনগুলিকে নিষ্ক্রিয় ও ধ্বংস করতে পারে এবং সংক্রমণের বিস্তার রোধ করতে পারে। ‘

এদিকে, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড সম্পর্কে অনেকটা একই  তথ্য দিয়েছেন হার্ভার্ডের আরেক গবেষক। ক্যামিকেলটির তেজস্ক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিকেল ইন্জিনিয়ারিং এর গবেষক ড: এমিলি বালশুককের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান,  ‘ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ‘ সাধারণত বিষ্ফোরকের মতো আচরন করে না। তবে জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া মাধ্যমে এটিকে অতি সংবেদনশীল দাহ্য পদার্থে রুপান্তর করা সম্ভব। একারনে এই কেমিক্যাল সাধারন জ্বালানী হিসেবে নয়, শুধু রকেট জ্বালানির মিশ্র পদার্থ হিসেবে  ব্যবহৃত হয়।  আগুনের সংস্পর্শে এটি সাময়িক সময়ের জন্য উদ্বেজকের ভুমিকা রাখে। ‘।

তিনি যোগ করেন ‘ হাইড্রোজেন পারক্সাইড খুব দ্রুত বিক্রিয়া করে। এটি হাইড্রোজেন এবং জলে বিভক্ত হবে, উপজাতের গঠন ছাড়াই। এতে পানি মিশানো হলে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়। একসময় অক্সিজেন র্যাডিকেল দ্বারা পচে যায়, এবং শুধুমাত্র জল অবশিষ্ট থাকে। ‘

এদিকে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে রপ্তানির জন্য মজুদ করা আল রাজী কেমিক্যালের  ‘ হাইড্রোজেন পার অক্সাইড‘ থেকে বিকট বিস্ফোরণের উদ্ভব হয়েছে- এমন অবিজ্ঞানিক তথ্য অগ্নিকাণ্ডের  মুল রহস্য  উদঘাটনকে দুরূহ করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছেন, কারণ ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছিল, সেটা ডিপোর কেউ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের জানায়নি।

গবেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী,  অতিরিক্ত  পানির কারনে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কার্যক্ষমতা নিঃশেষ হবার কথা, কারন এটা কেমিক্যালটির ধর্ম। অথচ সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে পানির ব্যবহারে বিস্ফোরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা হচ্ছে, অভিযানের শুরু থেকেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল হিসেবে পানি ব্যবহারে যথার্থতা প্রমানিত হয়নি। হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কারণেই এমন বিস্ফোরণ ঘটে থাকলে, পানি দিয়েই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো।

এমন তথ্য সত্যতা মিলেছে প্রত্যক্ষদর্শিদের বক্তব্যেও। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী শুরুতে আগুনের সুত্রপাত হওয়া কনটেইনারে পানির মাধ্যমে আগুন নিবানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে পানি ছিঁটানোর পরপর বিষ্ফোরনে রুপ নেয় আগুন।

আহত শ্রমিক হেলাল জানান, ‘ পানি ছিঁটানোর পর থেকে পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারন করে৷ থেমে থেমে তিনটি বিস্ফোরণের প্রবল শব্দে কেঁপে উঠে পুরো ইয়ার্ড। ‘

সরেজমিনে দেখা যায়, ঘটনাস্থল থেকে বেশকিছু দুরে অবস্থান করা বাড়িঘরের কাঁচ ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য অনুযায়ী বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটেছে। উড়ে আসা ধাতব বস্তুর আঘাতের কথাও বলছেন তারা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক (যুগ্ম সচিব) মোহা. নায়েব আলী বলেন, এই রাসায়নিক উপাদানটি তাদের কার্যতালিকাভুক্ত বিস্ফোরক নয়। সেকারনে এটি দাহ্য ক্ষমতা সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য নেই।

প্রসঙ্গত, আগুনের সুত্রপাত ও বিষ্ফোরণের কারন নিয়ে নানামুখী  বিশ্লেষণ চলছেও সোমবার মধ্যরাতেও থামানব বেসরকারি  কনটেইনার ডিপো ‘ বিএম’র আগুন। থেমে থেমে বিস্ফোরণে নতুন করে চাঙ্গা হচ্ছে কনটেইনারের আগুন। ফায়ার সার্ভিসের  ২৬ টি ইউনিট আর সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত ইউনিট শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।