মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব কাঁপানো অভিযানের নায়ক নৌ- কমান্ডো আবু মুসা চৌধুরীর ইন্তেকাল

বাংলাদেশ মেইল ::

মহান মুক্তিযুদ্ধে একের পর এক বিদেশী জাহাজ ধ্বংস করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর শক্ত অবস্থান জানান দেয়ার সেই মহা নায়ক নৌ-কমান্ডো বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুছা চৌধুরী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি…. রাজেউন)।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে তিনি ফটিকছড়ির হাইদচকিয়া গ্রামের মহব্বত আলী মুন্সী বাড়িস্থ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

শুক্রবার ( ৮ জুলাই) বাদে আসর রাস্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার ও নামাজে জানাযা শেষে তার পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

১৯৭১ সালের ২ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে গ্রিসের পতাকাবাহী তেলভর্তি জাহাজ ১৯ এমটি অ্যাভলুজ ধ্বংসের পর পাক হানাদার সরকার আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক জবাবদিহিতার মুখে পড়ে। বহির্বিশ্বে প্রচার হয়, পাকবাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

অ্যাভলুজের মালিকপক্ষ মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ চেয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে। তখন পাক সরকারের প্রতিনিধি মাহমুদ আলী এ বিষয়ে জাতিসংঘের কাছে ব্যাখ্যা প্রদানে বাধ্য হন। জাতিসংঘে তিনি বলেছিলেন, এ জাহাজ ধ্বংসের দায়দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের নয়, এটি ধ্বংসের জন্য দায়ী তথাকথিত মুক্তিবাহিনী।

এরপর ৮ নভেম্বর সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও নৌ কমান্ডোদের বীরত্বে হতাশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেছিলেন, ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্য আপনারা প্রস্তুত হোন। তথাকথিত মুক্তিবাহিনী বিদেশি জাহাজ ধ্বংস করায় কোনো বিদেশি জাহাজ খাদ্য নিয়ে পাকিস্তানে আসতে চাইছে না।

অ্যাভলুজ ধ্বংসের খবরটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে। অ্যাভলুজ ধ্বংসের পর বন্দরের মূল চ্যানেল নাব্যতা হারায় এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে বহির্বিশ্বের নৌ যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ এবং
মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি ছড়িয়ে পড়ে।

মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ব কাঁপানো এই অভিযানের নায়ক হচ্ছেন নৌ কমান্ডো আবু মুসা চৌধুরী। জাহাজটি ধ্বংস করা ছিল এই তরুণের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বলা যায়, ছোট মানুষের বড় কাজ। অ্যাভলুজ ধ্বংসের পর রণাঙ্গণ জুড়ে আলোচিত হন তিনি। এই অপারেশনের সময় মাইনের শব্দে সৃষ্ট মাথার ক্ষত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়বহুল চিকিৎসা বাঁচিয়ে রেখেছিল একাত্তরের এই বীরকে।

এমটি অ্যাভলুজ ধ্বংস করা কী কারণে প্রাসঙ্গিক ছিল? এ বিষয়ে আবু মুসা চৌধুরী বলেন, তেলভর্তি এমটি অ্যাভলুজ ধ্বংসের সময় পাকিস্তানিদের হাতে অ্যারেস্ট ছিল। আগস্টে নৌ কমান্ডোদের অপর সফল অপারেশন জ্যাকপট সম্পন্ন হওয়ার পর সম্ভাব্য আক্রমণ এড়াতে জাহাজটি লোকাল কান্ট্রি অর্থাৎ পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে রাখে। পতাকা নামানোর অপরাধে পাকিস্তানিরা জাহাজটি অ্যারেস্ট করে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করে। আমাদের লক্ষ্য ছিল, পাকিস্তানিদের হাতে আটক জাহাজটি তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় যেকোনো মূল্যে ধ্বংস করা; যাতে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। এর মাধ্যমে বিশ্ব আমাদের বীরত্বের কথাও জানবে।

তিনি বলেন, ওই দিন অ্যাভলুজ ছাড়াও এমভি মানা নামে আমেরিকান একটি জাহাজ ধ্বংসের পরিকল্পনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় লিমপেট মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধ্বংস করার। অ্যাভলুজের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। সহযোদ্ধা মনোজ কুমার দত্ত ধ্বংস করবে এমভি মানা। ২ অক্টোবর রাত ১২টায় পতেঙ্গার গুপ্তখালের দুই মাইল উজান থেকে শুরু হয় আমাদের দুঃসাহসিক অভিযান। খাল লাগোয়া এক বাড়ির রান্নাঘর থেকে খালি গায়ে পানিতে নামার প্রস্তুতি নিই। কোমরে বেঁধে নিই দুটি লিমপেট মাইন। পেটের সাথে গামছা বেঁধে পেচিয়ে নিই আরো দুটি মাইন। আরেকটি গামছায় পলিথিনের পুটলিতে লুঙ্গি, জামা, ৩০০ টাকা ও পিন্স ( সাঁতারের সময় পায়ে পরতে হয়)। এসব নিয়ে নেমে পড়ি খালে। তখন কর্ণফুলীর শাখা খালটিতে সবেমাত্র জোয়ারের পানি ঢুকছিল। এ অবস্থায় পায়ে পিন্স থাকায় হাঁটতে পারছিলাম না। তার ওপর খালের ঝোপে কাঁটার আঘাত। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। সেখানে লবণাক্ত পানি লাগায় তীব্র ব্যথা হচ্ছিল। তবুও এগোতে থাকলাম। রাজাকার ও পাক আর্মির শ্যেন দৃষ্টি ও বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে রাত ২টার পর অবশেষে কর্ণফুলীর যেখানে অ্যাভলুজ নোঙর করা ছিল, সেখানে পৌছি। জাহাজের ওয়াচম্যান আমাকে দেখে চিৎকার শুরু করে। সতর্ক হয় পাহারায় থাকা পাক সেনারা। রাস্তার পাশ দিয়ে ছুটছিল তারা। সঙ্গে চালাচ্ছিল বৃষ্টির মতো গুলি। এর আগেই আমি ডুব দিয়ে বিপরীত দিকে চলে যাই। জাহাজটির ইঞ্জিন বরাবর অংশে ছুরি দিয়ে শেওলা পরিষ্কার করে দু-তিন মিনিটে একটি লিমপেট মাইন লাগাই। এর পরপরই আরেকটি লাগাই। এসব মাইন ৪৫ মিনিট পর বিস্ফোরণের নিয়ম থাকলেও আমি নির্ধারিত দূরত্ব অতিক্রম করার আগে ১০ মিনিটের মাথায় প্রথম মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠি। কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হয়নি আমার মাইন। প্রথম মাইন বিস্ফোরণের সাথে সাথে ১৭ হাজার মেট্রিক টন ওজনের জাহাজটি শূন্যে ওঠানামা করে। এরই মধ্যে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ি। বিকট শব্দে নাক ও কান দিয়ে রক্ত ঝরছিল। আধ ঘণ্টা পর কোনো রকমে কর্ণফুলীর দক্ষিণপাড়ের কাছাকাছি পৌছতেই শুনতে পাই দ্বিতীয় মাইন বিস্ফোরণের শব্দ। এতে জাহাজটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

নৌ কমান্ডো আবু মুসা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে এটিসহ ছয়টি সফল নৌ অপারেশন করেন। অ্যাভলুজ তাঁর তৃতীয় অপারেশন। প্রথম অপারেশন আগস্টের অপারেশন জ্যাকপট, দ্বিতীয় অপারেশন আউটার অ্যাঙ্কর। অ্যাভলুজের পর বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরী মোহনায় এমভি তুরাগ ধ্বংস, নারায়ণগঞ্জ বিশ্ব গোডাউনের সামনে জাতিসংঘের রসদবাহী জাহাজ মিনি লেডি ও মিনি লায়ন ধ্বংস এবং কাঁচপুর ফেরি ও পন্টুন উড়িয়ে দেওয়ার অভিযানে ছিলেন এই অন্যতম বীর। এসব নৌ অপারেশন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।