সংগ্রহকারী চোখে পড়েনি অধিকাংশ এলাকায়
চট্টগ্রামে কোরবানির চামড়ার বাজারে পুরোনো ফিসফাস

টানা তিনবার কোরবানি পশুর চামড়ার বাজারে ধ্বসের অভিজ্ঞতা রয়েছে চামড়া ব্যবসায়ীদের। সেই কারনে কোরবানির আগেই নিজেদের শংকা প্রকাশ করেছিলেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। কোরবানির প্রথম দিনের চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষন, বিক্রির বাজার পরিস্থিতি দেখে সেই সম্ভাবনার কথা জোরালো হচ্ছে।

কোরবানির পর গরু-ছাগলের চামড়া কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে স্থানীয়ভাবে মৌসুমি সংগ্রহকারীদের কিনে রেওয়াজ বন্দরনগরীতে দীর্ঘদিনের। এলাকার প্রভাবশালী তরুণ-যুবকসহ বিভিন্ন বয়সী প্রভাবশালী লোকজন কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে নিয়ে আড়তদারদের কাছে পৌঁছে দেন। নামাজের পরপরই বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় অসংখ্য মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীর ভিড় দেখা গেলেও এবার তাদের দেখা মেলেনি,চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকায়।

বিকেলে সরেজমিন মুরাদপুর,  আতুরার ডিপো, কালামিয়াবাজার, নাসিরাবাদ , হালিশহর এলাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ঘুরে দেখা গেছে, কোরবানি করা বেশিরভাগ পশুর চামড়া রাস্তায় পড়ে আছে। বেলা ১১টা পর্যন্ত কোরবানি সম্পন্ন হওয়া পশুর চামড়াগুলো কেনার জন্য তখনও কেউ আসেননি। ফলে অধিকাংশ চামড়াই দুপুরের পরে স্থানীয়  মসজিদ মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেবার প্রবণতা দেখা গেছে।

গেল দুই বছর নায্য দাম না পেয়ে ১০-১৫ শতাংশ গরুর চামড়া সড়কে ফেলে এবং মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।  সময়মতো লবণ না দেওয়া, বৃষ্টি ও গরমের কারণেও ২০ শতাংশ গরুর চামড়া নষ্ট হয়েছিল। বিশ্লেষকদের মতে, নষ্ট হওয়া চামড়ার আর্থিক মূল্য ছিল কমপক্ষে ২৪২ কোটি টাকা।

বরাবরের মত এবারও চট্টগ্রামে  পশু কোরবানি  রাস্তার পাশে আর অলিতে গলিতে। সেখানেই জবাই করা পশুর শরীর থেকে চামড়া ছাড়িয়ে আলাদা করা হচ্ছে। চাটাই পেতে চলছে মাংস কাটার কাজ। সাধারণত স্থানীয় মসজিদ-মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোর লোকজনই পাড়া মহল্লার বাড়ি বাড়ি ঘুরে দান হিসেবে চামড়া সংগ্রহের কাজটি করে। আবার কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীও ঈদের দিন চামড়া কিনে নেন। গেল দুই বছরের মতো ব্যতিক্রম দেখা গেছে এবারও। চামড়া আছে ক্রেতা নেই।

রোববার সকাল থেকেই চলছে  চামড়া সংগ্রহের তৎপরতা শুরু হবার কথা । পরে তা বিক্রি হবে চামড়ার পাইকার ব্যবসায়ীদের কাছে। সরকার এবার লবণ দেওয়া প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে । আর খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর কোথাও পাঁচ টাকার উপরে খাসির চামড়া ক্রয় বিক্রির দৃশ্য চোখে পড়েনি। খুচরা সংগ্রহকারীরা ২ থেকে দশ টাকায় প্রতিটি খাসির চামড়া  কিনেছে৷  আর আড়তে বিক্রি করতে হয়েছে পাঁচ টাকায়।

লবনের দাম বাড়ার কারনে বেড়েছে খরচ, তাই আগে থেকেই বুঝে-শুনে চামড়া কেনার পরামর্শ দিয়েছিলেন ট্যানারি মালিকরা।

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কোরবানির পশুর চামড়া ‘বুঝে-শুনে’ কেনার পরামর্শ দিয়েছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। তারা বলছেন, এ বছর লবণের দাম বেড়েছে অনেক। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবহন ও শ্রমিকসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়। সেই অনুযায়ী চামড়ার দাম বাড়ছে না।

রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেন, চলতি বছর বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। তবে দাম সেভাবে বাড়েনি। এটি মাথায় রেখে চামড়া কেনার পরামর্শ দেন তিনি।

আতুরার ডিপোর পাইকাররা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে, তা নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিছু কিছু ট্যানারি ফড়িয়াদের মাধ্যমে সরাসরি কম দামেও চামড়া সংগ্রহ করে।

চট্টগ্রামে কোরবানির গরুর চামড়া প্রতি পিস ১০০ -১৫০ টাকায় কিনছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার ও ট্যানারি মালিকদের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও কম দামে চামড়া বিকিকিনি হচ্ছে। আর বিক্রেতাদের অভিযোগ, গুদামে গুদামে ঘুরেও মিলছে না ন্যায্য দাম। বাধ্য হয়ে কম দামেই হাত বদল হচ্ছে কাঁচা চামড়া। রবিবার রাত নয়টা পর্যন্ত হালিশহর বউবাজার, রঙ্গিপাড়া, বেপারীপাড়া, কাটগরবাজার, মুরাদপুর, বিবিরহাট, বহদ্দারহাট, চকবাজার ঘুরে চামড়ার সংগ্রহ, পাইকারদের ক্রয়, গুদামজাত পরিস্থিতি সন্তোষজনক মনে হয়নি৷

চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন  বলেন,  আগে প্রতিবছরই পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ পিস কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকতো। লবণের দাম ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে ন্যায্যদাম না পাওয়ার কারণে  কমেছে লক্ষ্যমাত্রাও। এবছর আমরা সাড়ে তিন থেকে চার লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। ‘

এদিকে, চট্টগ্রামের আড়তদাররা জানান, ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহন করলেও অনেক ট্যানারি মালিকরা গতবছরের বকেয়া পরিশোধ করেন নি।ফলে চামড়া কেনাকে ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন অধিকাংশ আড়তদার।

জানা গেছে সময় সাথে সাথে চট্টগ্রামে  ২২ টি ট্যানারি গড়ে উঠলেও , শেষ পর্যন্ত অস্তিত্বের লড়াইএ টিকে আছে মাত্র একটি। ফলে ঢাকার ট্যানারিগুলোর মনোভাবের উপরই নির্ভর করবে চট্টগ্রামের চামড়ার বাজার। চট্টগ্রামে রীফ ট্যানারি এক লক্ষ চামড়া সংগ্রহের লক্ষমাত্রা নির্ধারন করেছে। অথচ চট্টগ্রামে এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু কোরবানি দিয়েছে অন্তত সাত লক্ষ পরিবার৷

চট্টগ্রামের আড়তদাররা জানান, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশি সংখ্যক চামড়া সংগ্রহের ঝুঁকি রয়েছে। কারন স্থানীয় ভাবে চামড়া কেনার ট্যানরি  নেই । এক সময় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে ২২টি ট্যানারি ছিল। কিন্তু লোকসানের কারণে সব ট্যানারিই বন্ধ হয়ে যায়। এখন চট্টগ্রামে রিফ লেদার নামে একটি ট্যানারি রয়েছে। এর ক্রয়ক্ষমতাও খুব বেশি নয়।

চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মাহবুবুল আলম তালুকদার বলেন,  চামড়া ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই খাতের আগের খেলাপি ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিনিয়োগের জন্ড নতুন ঋণ আবেদনের অনুমতিও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই আশা করা যায় বিগত বছরগুলোর মতো হবে না এবার। ‘