সাধারন ডায়েরি করেও সুরক্ষা মেলেনি
মাদক ব্যবসায়ী পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলায় আইনের ছাত্রী রিহ্যাবের জালে

বাবা ভাইদের মাদক ব্যবসার প্রতিবাদ করার কারনে ‘আফসানা আক্তার ‘ (ছদ্ধনাম) নামের এক ভার্সিটি শিক্ষার্থী নিজেই আটকে গেছেন রিহ্যাব সেন্টারের জালে । শুক্রবার  তাকে ঈদ করার কথা বলে বাসায় এনে শনিবার সকালে সুকৌশলে ঢাকার একটি রিহ্যাব সেন্টারকর্মীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রামের হালিশহরের কে ব্লকে সাজেদা ভবনে পরিবারের সাথে বসবাস করে আসছিলেন চট্টগ্রাম  ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ছাত্রী আফসানা আক্তার (ছদ্ধনাম)।  একমাসে আগে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সিএমপির হালিশহর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি।

রিহ্যাব সেন্টারের কর্মীদের হাত থেকে চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির এই ছাত্রী বাঁচার আকুতি জানিয়ে ক্লাসের ফেসবুক গ্রুপে মেসেজ দেয়। বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশ হালিশহরের বাসায় পৌঁছে শনিবার পৌনে বারোটার দিকে।

কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটিকে রিহ্যাব সেন্টারের লোকজন ধরে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দেয়। মিরসরাই এলাকা থেকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সর্বশেষ ছবি পাঠান গণমাধ্যমকর্মীদের।

হালিশহর থানার সুত্র জানায়, বাবা ও ভাইদের নির্যাতনের শিকার হয়ে সাধারণ ডায়েরী করার পর গত মাসে মেয়েটিকে বাসা থেকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পড়াশোনার স্বার্থে মেয়েটি পুলিশের সহযোগিতায় চকবাজারের কাপাসগোলার সাত মৌলানার মাজার এলাকায়   একটি পরিবারের সাথে সাবলেট বাসায় উঠে। ৮ জুলাই (শুক্রবার) বিকাল চারটায়  সেই ভাড়া বাসা থেকে ঈদ করার কথা বলে বাসায় নিয়ে যান তার বোন জেসমিন। কিন্তু শনিবার সকাল নয়টায়  ঢাকা থেকে একটি রিহ্যাব সেন্টারের লোকজনের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে তাকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি আইন বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের এই শিক্ষার্থীর পিতার নাম আব্দুর রশিদ খুলো। তাদের গ্রামের বাড়ি টেকনাফ। টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপের বাজারপাড়ায় রশিদ খুলো বেশ পরিচিত।  ফয়সাল এবং মোহাম্মদ  ফারুক নামে মেয়েটির দুই ভাইও ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত। এর মধ্যে ফয়সাল গ্রেফতার এড়াতে বেশ কয়েকবছর আগে মালেশিয়া পালিয়ে যান। সম্প্রতি দেশে ফিরে বাবা,বোনসহ পুরো পরিবার নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেবার পরিকল্পনা করে ফয়সাল। ভুক্তভোগী মেয়েটি শুরু থেকে পড়াশুনা চালিয়ে যাবার বিষয়ে অনড় থাকায় বিদেশে যেতে রাজি করানো যায় নি তাকে। পারিবারিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে আইনী সুরক্ষা চেয়ে মেয়েটি আদালতে সাধারণ ডায়েরী করেন।

এবিষয়ে চট্টগ্রাম ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি আইন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. চোধুরী গালিব জানান, এই শিক্ষার্থীর বন্ধুদের কাছে খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করার বিষয়ে  হালিশহর থানাকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু আইনী অভিভাবক বাবা হবার কারনে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে অপারগতা জানিয়েছে। ‘।

জানতে চাইলে উপ পুলিশ কমিশনার আব্দুল ওয়ারিস গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, মেয়েটিকে একবার উদ্ধার করা হয়েছিল। সে নিজের জিম্মায় বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠে। এখন নিজেই নাকি বাসায় গেছে৷ অভিভাবকরা তাকে রিহ্যাব সেন্টারের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাদের দাবি মেয়েটির মানসিক সমস্যা রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আফসানার (ছদ্মনাম) সহপাঠীদের অভিযোগ পুলিশের কাছে বাঁচার সাহায্য চেয়েও সে সাহায্য পায় নি। পুলিশ মেয়েটিকে রিহ্যাব সেন্টার কর্মিদের হাতে তুলে দিতে সহযোগিতা করেছেন-এমন অভিযোগ করেন তারা।

ফয়সালের বিরুদ্ধে পুলিশের পিসিপিআরে চারটি মামলার ওয়ারেন্ট রয়েছে। চান্দগাঁও থানা, চকবাজার, পাঁচলাইশ থানা, টেকনাফ থানার চারটি মাদক মামলার আসামী ফয়সাল দীর্ঘদিন দেশের বাইরে পালিয়ে ছিলো।

পিসিপিআর অনুযায়ী টেকনাফ থানার ২০১৮ সালে এফআইআর ১৪/১০৩ মাদক আইনে দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মোহাম্মদ  ফয়সল।   সিএমপির চকবাজার থানার ২০১৫ সালের ২৫ অক্টোবর দায়ের করা মাদক আইনের মামলা নং ৯,  ধারা ১৯(১) ৯ (খ) আসামী মোহাম্মদ ফয়সাল।

নগরীর বায়েজিদ থানায় ২০১৮ সালে দায়ের করা ৪০/৩৭৪ নং মাদক মামলার আসামীও ফয়সাল। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা রয়েছে।

দেশে ফেরার পরে ভুক্তভোগী মেয়েট (বোন)  দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পাসপোর্ট আবেদন করা হয়েছে। সেই আবেদনের কপিও প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহির আহমেদ জানান, যেহেতু মেয়েটির পরিবারের অভিভাবক বাবা,ভাইরা- তাকে রিহ্যাবে দিতে চাচ্ছে,  সে মাদকসেবি কিনা সেটা জরুরী না। পুলিশের সুরক্ষা দেবার আইনগত অধিকার নেই৷ ‘

তবে ভুক্তভোগী ছাত্রীর বড়বোন জেসমিন জানান, সে আইনের ছাত্রী সে কোন ভাবেই মাদকাসক্ত নয়৷ গতকাল আমি তাকে ঈদের ছুটিতে বাসায় নিয়ে আসি। কিন্তু ভাইরা তাকে রিহ্যাব দিতে চাচ্ছে। বড় বোন হিসেবে আমারও কিছু করার নেই। সে যেহেতু আগেই সাধারন ডায়েরি করেছিল।  পুলিশ সুরক্ষা দিতে চাইলে সেইফটি কাস্টুডিউ বা  তাকে আমি আমার বাসায় রাখতে পারবো। ‘

এদিকে, টেকনাফে শাহ পরীর দ্বীপের বাজারপাড়ায় খবর নিয়ে জানা যায় রশিদ আহমেদ, রশিদ খুলো হিসেবে পরিচিত। তারা চট্টগ্রামে বসবাস করেন। রশিদ খুলো ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মাদক মামলা রয়েছে। দীর্ঘদিন বড়ছেলে দেশের বাইরে পালিয়ে রয়েছেন বলেও জানায় স্থানীয়রা।

ধারনা করা হচ্ছে পরিবারের মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার কারনে এই ছাত্রীকে মাদকসেবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেস্টা করছে তার পরিবার। যদিও বড় বোনের দাবি সে মাদকাসক্ত নয়। শিক্ষকরাও জানিয়েছেন মেয়েটি মাদকাসক্ত নয়, তার মানসিক কোন সমস্যাও ছিলো না।