কালুরঘাট ফেরির নিয়ন্ত্রণ
সাতবার টেন্ডার তবুও সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা না দেবার কূটকৌশল

নাদিরা শিমু :::

কালুরঘাট সেতুর সংস্কার কাজ চলাকালীন সময়ে ফেরি চলাচল ও ফেরি ঘাটের ইজারা নিয়ে সড়ক ও জনপদ বিভাগের কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য, লুটপাটের তথ্য  ফাঁস হয়েছে। ফেরিঘাট ইজারার জন্য এখন পর্যন্ত  সাত দফা টেন্ডার হবার পরও প্রত্যেক বারই সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেয়া নিয়ে নানা কূটকৌশল ও দূর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে সওজ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা, সহকারী প্রকৌশলী সেগুন প্রসাদ বড়ুয়া।

সর্বশেষ ২৪ শে আগস্ট দরপত্র খোলার পর সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয় এ কে এন্টারপ্রাইজ। দরপত্র মুল্যায়নের আগে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান এ কে এন্টারপ্রাইজের পে অর্ডার না থাকার কথা উল্লেখ করে কর্মকর্তারা বলেন, ‘ দুই কোটি পঁচিশ লাখ টাকা দর কোড করেছে এ কে এন্টারপ্রাইজ। কিন্তু তাদের দেয়া পে অর্ডার কম আছে। তাদেরকে  চিঠি দিয়ে পে অর্ডার জমা দেবার নির্দেশ দেয়া হবে৷ ‘

কিন্তু পরবর্তী কার্য দিবসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা আমরিন এন্ড ব্রাদার্সকে  সিএস দেবার সুপারিশ  করে নথি পত্র নিযে স্ব শরীরে নিয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে জমা দেন পিন্টু চাকমা।

কর্ণফুলী নদী পারাপারে ফেরি ঘাট ইজারার দরপত্র আহবান ও বিভাগীয় পদ্ধতিতে টোল আদায়ে এক তৃতীয়াংশ টাকাই ডুকেছে সওজ কর্মকর্তাদের পকেটে । এখন পর্যন্ত সাতবার টেন্ডার আহবান করার পরও ‘ আমরিন এন্টারপ্রাইজ ‘নামের একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে ফেরি ইজারা দিতে বার বার রি টেন্ডার করছে সংস্থাটি, এমন অভিযোগ ও কানাঘুঁষা চট্টগ্রামের সড়ক ভবনে। সর্বশেষ ২৪ শে আগস্ট ওপেন করা টেন্ডারে সওজ’র পছন্দের প্রতিষ্ঠান আমরিন এন্ড ব্রাদার্স  দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হয়। সাতবার টেন্ডার আহবান করা হলেও  প্রতিষ্ঠানটি প্রথম বারের মতো দরপত্র জমা দিয়েছে।

মুল্যায়ন কমিটি গঠন ও মুল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরির কাজ সম্পন্ন না হলেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা আমরিন এন্ড ব্রাদার্সের মালিক মনসুর আলম পাপ্পী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে ফেরি ঘাটটির ইজারাদার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের সচিব আমানুল্লাহ নুরী প্রতি। সচিবের সাথে সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ে তোলা নিজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট দেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচিব ও ঠিকাদারের এমন ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর সচিবালয়ে বিষয়টি নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, ফেরিঘাটের ইজারা টেন্ডারে  অনিয়ম তদন্তে  প্রথম সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান এ কে এন্টারপ্রাইজ এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান মাহফুজ এন্টারপ্রাইজ পৃথক পৃথক অভিযোগ জমা দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে। ঠিকাদারদের অভিযোগ নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা, সহকারী প্রকৌশলী সেগুন প্রসাদের প্রত্যক্ষ মদদে আমরিন এন্ড ব্রাদার্স’কে কম মুল্যে ইজারা দেবার প্রক্রিয়া করা হয়েছে। বার বার টেন্ডার করার পরও ‘সিএস ‘  দেয়া হয় নি সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু ২৪ আগস্ট টেন্ডার অপেন করার ৭২ ঘন্টা যেতে না যেতেই নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা আমরিন এন্ড ব্রাদার্সের অনুকুলে  সিএস’ দেবার সুপারিশ করেছেন।

নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার দাবি সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান এ কে এন্টারপ্রাইজ পে অর্ডার জমা দেয় নি। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির  এগারো লাখ টাকার পে অর্ডার জমা রয়েছে সড়ক ও জনপথ চট্টগ্রাম কার্যালয়ে। ইতিপূর্বের টেন্ডারেও প্রতিষ্ঠানটি অংশ নিয়েছে। রীতি অনুযায়ী রাস্ট্রের স্বার্থে সর্বোচ্চ দরদাতার পে অর্ডার কম থাকলে পে অর্ডার জমা দেবার জন্য চিঠি দেয়া হয় দরপত্র আহবানকারীর পক্ষ থেকে।

সুত্রমতে, ইজারা প্রক্রিয়া দীর্ঘ করে বিভাগীয় পদ্ধতিতে টোল আদায় করলেই লাভবান হচ্ছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীরা। ১ লা আগস্ট থেকে ৪ ঠা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৪ দিনে ২২ লাখ ১৮ হাজার পাঁচশত ৮০  টাকা (২২,১৮,০৫৮০) রাজস্ব আদায় হয়েছে ফেরি ঘাট থেকে। অথচ সর্বোচ্চ দরদাতার কোটেশন অনুযায়ী শুরু থেকে ফেরি ইজারা দেয়া হলে একই সময়ে সরকার ৪২,৫০,০০০ টাকা রাজস্ব পেতো। ইজারা প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার কারণে  সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা , সহকারী প্রকৌশলী সেগুন প্রসাদসহ দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পকেটে ডুকেছে প্রকৃত রাজস্বের অন্তত ত্রিশ লাখ টাকা। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গড়ে দৈনিক  ৬৫ হাজার টাকা আদায় করেছে সড়ক ও জনপথ। অথচ গণমাধ্যমে কালুরঘাট  ফেরিঘাট নিয়ে  লুটপাটের খবর প্রকাশিত হবার পর  ৩১ শে আগস্ট থেকে ৪ঠা সেপ্টেম্বর মাত্র পাঁচদিনে  ৩ লাখ ৬৯ হাজার চারশ টাকা ( সর্বোচ্চ)  রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। শেষ দিকে টোল আদায়ের এই  অংকটি উপার্জিত  দৈনিক গড় থেকে ৮ হাজার আটশ টাকা বেশি।

অনুসন্ধানে জানা যায় , আমরিন এন্ড ব্রাদার্সকে কালুরঘাট ফেরির ইজারা দেবার বিষয়টি আগে থেকেই চুড়ান্ত করা ছিলো। আমরিন এন্ড ব্রাদার্স  দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হবার কারণে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান এ কে এন্টারপ্রাইজের পে অর্ডার সমস্যা দেখিয়ে  তড়িঘড়ি করে ‘সিএস ‘ দেবার সুপারিশ করা হয়েছে।

পে অর্ডার কম থাকার কারণে সর্বোচ্চ দরদাতা এ কে এন্টারপ্রাইজকে ‘ইনফরমাল’ করার কূটকৌশল ব্যবহার করেছে পিন্টু চাকমা এবং সড়ক ও জনপথ চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। ইতিপূর্বে ‘পে অর্ডার ‘ কম থাকার পরও ইজারা দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ দরদাতাকে – এমন তিনটি ‘সিএস’ মিলেছে অনুসন্ধানে। এর একটিতে স্বাক্ষর করেছেন খোদ নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা। রাষ্ট্রের রাজস্বের স্বার্থে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে  কেন ‘ সিএস ‘ দেবার সুপারিশ করেন নি নির্বাহী প্রকৌশলী  পিন্টু চাকমা – এমন প্রশ্ন দূর্নীতি নিয়ে কাজ করা আইনজীবীর।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)  চট্টগ্রামের সম্পাদক এডভোকেট আকতার উল কবির মনে করেন, যে প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রকে বেশি রাজস্ব দেবে, তাকেই ইজারা দেয়া উচিত। সবধরনের আইনই রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রনয়ণ করা হয়েছে। যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রাস্ট্রবিরোধী কোন কার্যক্রম বা মালিক ফৌজদারি মামলার আসামি না হয় তবে সর্বোচ্চ দরদাতাই ইজারা পাবার অধিকার রাখেন।’

পিপিআর বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায়,  পিপিআর ( পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস)  বিধিমালায়  সরকারি  ক্রয়  সংক্রান্ত আইনী নির্দেশনা থাকলেও এই বিধিমালার বাইরে ইজারা বা নিলামের ক্ষেত্রে পৃথক নীতিমালা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, পুনরায় টেন্ডার আহবান করে ইজারাদারের হাতে ফেরি হস্তান্তরকে দীর্ঘায়িত করতে চায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান আমরিন এন্ড ব্রাদার্সকে ফেরিঘাট ইজারা দেয়ার সুপারিশ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে, নড়েচড়ে বসে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান কার্যালয়ের শীর্ষকর্তা। ফলে সৃষ্ট বিতর্ক এড়াতে কালুরঘাট ফেরির ইজারার জন্য পুনরায় টেন্ডার আহবান করা হতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তা বলেন, পুরোটাই পকেট ভর্তি করার একটা কুটকৌশল। ফেরিঘাট ইজারা প্রক্রিয়ায় আরও বেশি সময় ব্যয় হলেই লাভ তাদের। রি টেন্ডারের ফাঁদ পেতে  অতীতের মতো পকেট ভর্তি করবে আরও অন্তত একমাস। দরপত্রে অংশ নেয়া ঠিকাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা, সহকারী প্রকৌশলী সেগুন প্রসাদসহ চার কর্মকর্তা ফেরিঘাট থেকে উঠা টাকা থেকে আগামী এক মাসে  ত্রিশ লাখ টাকা পকেটস্থ করবেন।

বিএম/অনুসন্ধান