তানভীর আহমেদ ::
পবিত্র রমজান মাস কে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নামে পণ্য পরিবহনের গাড়িতে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে মেতেছে একটি চিহ্নিত চক্র । আর তাদের এই বেপরোয়া চাঁদাবাজির খেসারত দিতে হচ্ছে পণ্য পরিবহন ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষকে ।
বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন ও চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়ন নামক দুটি সংগঠন পণ্য পরিবহন গাড়ির নিকট থেকে চাঁদাবাজির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত । বিশেষ টোকেন এর মাধ্যমে পন্য পরিবহন সেক্টরে তারা ব্যাপক চাঁদাবাজি করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ । শুধু তাই নয়, তারা প্রকাশ্যে দম্ভোক্তি করে বলেন
” বিভাগীয় কমিশনারদের সাথে সরাসরি চুক্তি করে আমরা এই কাজ করছি ” । এই সংক্রান্ত একটি ভিডিও এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে । ইতিমধ্যে ভুক্তভোগী এক পরিবহন ব্যবসায়ী এই দুই সংগঠনের পক্ষে চাঁদা আদায়কারী সেলিমের বিরুদ্ধে মামলা করলে সে গ্রেফতার হয় এবং পরবর্তীতে জামিনে বের হয়ে এসে পুনরায় একই কাজে লিপ্ত হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজারের বেশি গাড়ি প্রবেশ করে । এই দুইটি শ্রমিক সংগঠন বিশেষ টোকেনের মাধ্যমে দৈনিক ট্রেইলার থেকে ৫০ টাকা এবং ট্রাক, মিনি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান থেকে ৩০ টাকা করে টাকা আদায় করে প্রকাশ্যে । প্রতিদিন তারা ৬- ৮ লাখ টাকা আদায় করে এইভাবে। বছরে তাদের আদায়কৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২২ কোটি টাকা । আর এই ২২ কোটি টাকার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে পণ্য পরিবহন ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ কে ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পণ্য পরিবহন ব্যবসায়ী বলেন, ” ডলার সংকটের পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ এমনিতেই জর্জরিত । তার উপর পন্য পরিবহনে এই ধরনের বেপরোয়া চাঁদাবাজির প্রভাব পড়ছে পরিবহন সেক্টর সহ দ্রব্যমূলের বাজারে । ফলশ্রুতিতে যে পণ্য ২০ টাকা সেটি সাধারণ মানুষকে খুচরা বাজার থেকে কিন্তু হচ্ছে ৬০- ৮০ টাকায় । চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক পণ্য পরিবহন সেক্টরে এই ধরনের বেপরোয়া চাঁদাবাজি বন্ধে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি ” ।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন এর সভাপতি সফিকুর রহমান বলেন,
” আমি বর্তমানে অফিসে নাই।সেক্রেটারি সাহেবের সাথে কথা বলুন “।
এই ব্যাপারে জানার জন্য উক্ত সংগঠনের সেক্রেটারি আব্দুস সবুর এর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ” আমরা নিয়মের মধ্যে সব কিছু করছি । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন নিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অধিশাখার ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এবং ২০২২ সালের ২৩ মার্চের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। আমাদের সংগঠনের মৃত ৬০ সদস্যের প্রত্যেক পরিবারকে এককালীন ৬০ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করা হয়েছে এবং কাজ করতে গিয়ে আহত ২০০ সদস্যকে আমরা সাহায্য করেছি। সংগঠনের অডিট করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি করোনার দোহাই দিয়ে বলেন করোনার পর থেকে অডিট করা হয়নি এটি শীঘ্রই আমরা করে ফেলব “।
তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ এর ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ও ২৩ মার্চ ২০২২ এ অনুষ্ঠিত সভার চিঠি এই প্রতিবেদকের হস্তগত হয়েছে । সেখানে উল্লেখ আছে ,
” সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ চাঁদা উত্তোলন বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । পণ্যবাহী যানবাহনে এই বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ” ।
কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের কারো সাথেই এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা সমন্বয় না করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম ভাঙিয়ে দীর্ঘদিন এই অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে আসছে ।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে , এই সংগঠনের রয়েছে প্রায় ১৩ হাজার সদস্য।এর মধ্যে এক থেকে দেড় হাজার সদস্য মারা গেছেন বলে দাবি করছেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা । প্রতিটি সদস্য থেকে তারা প্রতি মাসে ৩০ টাকা করে আদায় করেন সদস্য ফি হিসেবে । এই খাত থেকে প্রতিমাসে আদায় করা হয় ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা । বছরে আদায় হয় ৪৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা । এই বিপুল অংকের টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয় সেটিও জানে না সাধারণ সদস্যরা । বিগত চার বছর ধরে এই সংগঠনের অডিট ও করা হয়নি। সংগঠনের বেশ কিছু সাধারণ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন , ” বছর দুয়েক যাবত লোক দেখানো এককালীন সহায়তা ব্যতীত এই সংগঠন থেকে আমরা কিছুই পাইনি । নেতৃবৃন্দরা সাধারণ সদস্যদের মাথা বিক্রি করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে । এই সব অনিয়ম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে আমাদের মারধর করা হয় “।
চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ট্রেইলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম খান এই ব্যাপারে বলেন , ” আমাদের সংগঠনের কেউ চাঁদাবাজির সাথে সম্পৃক্ত নয় তবে কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন রাস্তায় সংগঠনের সদস্যদের ব্যয় নির্বাহের জন্য ৫০ টাকা আদায় করা হয় প্রতিটি ট্রেইলার থেকে ” ।
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিসি ট্রাফিক ( পশ্চিম) তারেক বলেন, ” চাঁদাবাজির তথ্যগুলো আমাকে জানান, আমি কঠোর ব্যবস্থা নেবো ” ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে এই দুটি সংগঠনের প্রকাশ্যে কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের প্রশ্ন তুলেছেন অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা । তারা বলছেন, এটি সম্পূর্ণ অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে এবং সাধারণ সদস্যদের মাথা বিক্রি করে এই দুই সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নিজেদের আখের গুছিয়েছে । এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।
পরিবহন সেক্টরের বিশ্লেষকদের মতে,
” চাঁদাবাজদের কারণে পরিবহন খাত অশান্ত হওয়ার পূর্বেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত”।