প্রাথমিক শিক্ষায় অনন্য উদ্দ্যেগ ‘মিড ডে মিল’

    প্রাথমিক শিক্ষায়

    প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার শুরু এবং ভিত্তি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এই স্তরেই সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। আমাদের দেশেও ক্রমান্বয়ে  শিক্ষাকে আধুনিকায়ন এবং যুগোপযোগী করে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে দীর্ঘদিন থেকে আলোচনায় থাকা জাতীয় মিড ডে মিল নীতি- ২০১৯ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

    এটি নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশাল অর্জন। বিনামূল্যে বই বিতরণের পর এটি সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। সারাদেশে বর্তমানে ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ১শ ৪ উপজেলার ১৫ হাজার ৩৮৯ টি বিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলকভাবে দুপুরে খাবার দেয়া হয়। এর ফলে বেড়েছে উপস্থিতির হার। মূলত শিশুদের পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে, উপস্থিতির হার বাড়াতে এবং লেখাপড়া মনোযোগ ধরে রাখতে এই প্রকল্প অত্যন্ত কার্যকর।

    প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় প্রতিযোগীতা বেসরকারি স্কুলের সাথে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শতভাগ ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সবকিছু ভালো হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রী কিন্ডারগার্টেনের দিকে ঝুঁকছে। ফলে প্রায়ই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো তীব্র প্রতিযোগীতার মুখোমুখি হচ্ছে।

    প্রাথমিকভাবে যেসব বিদ্যালয়ে মিড ডে মিলের কার্যক্রম চালু রয়েছে সে বিদ্যালয়গুলোতে যখন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে তখন অন্য বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে খুব বেশি হেরফের হবে না বলেই বিশ্বাস।

    বিশেষ করে নিন্ম আয়ের মানুষের সন্তান যাদের বাড়িতে পুষ্টিমান নিশ্চিত সম্ভব হয় না তারাও এর ফলে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।

    অভিভাবকরাও আগ্রহী হবে সন্তানকে নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠাতে। শিক্ষকদের সাথে অভিভাবকের একটু সমন্বয় থাকলেই বিষয়টি আরও সহজ হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে সারাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হবে।

    খাদ্য তালিকায় রান্না করা খাবার,ডিম,কলা ও বিস্কুট থাকবে।

    প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক ধাপ। সব ধরণের যুগোপযুগী পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও আজ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা কাঙ্খিত অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। সময়ের সাথে সাথে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য করার উদ্যেগ গ্রহণ করেছে। কয়েকটি সিদ্ধান্ত সবার সাধুবাদ পেয়েছে।

    এর মধ্যে রয়েছে আগামী বছর থেকে শিক্ষার্থীকে বছরের শুরুতেই তার স্কুল ড্রেস বা পোশাক বিনামূল্যে দেয়া, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল এবং তার বদলে কয়েকটি মানদন্ডে মূল্যায়ন এবং স্কুল ফিডিং এর কার্যক্রম হাতে নেয়া। দেশের লাখ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর জন্য এতসব নিশ্চিত করা যে বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু এর সবগুলোই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে এবং এর গুণগত মানকে আরও বেশি কার্যকর করে তুলবে। এতদিন বছরের শুরুতে নতুন বই নিয়ে আনন্দে বাড়ি ফিরতো শিক্ষার্থীরা। এখন তার সাথে যদি স্কুলের পোশাকও হাতে পায় তাহলে আনন্দের মাত্রা যে আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় একটি বড় পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরিবর্তন তখনই কার্যকরী সুফল বয়ে আনবে যখন এর সাথে লেখাপড়ার মান নিশ্চিত করা যাবে। দেশে অলিতে গলিতে,বিল্ডিংয়ের কোনায় ব্যঙের ছাতার মত কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। এসব হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন নিয়ন্ত্রণে কোন নজরদারি নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি বহু আইন এসব কিন্ডারগার্টেনে উপেক্ষিত। উপেক্ষিত হওয়ার কারণ তাদের দিকে নজরদারি করার কেউ নেই। এত সুযোগ সুবিধা দেওয়া সত্তেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। কারণ ফলাফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোই এগিয়ে থাকে। ফলে অভিভাবকদের আগ্রহটাও থাকে এসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে।

    সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল করার লক্ষ্যে গেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌছে দিচ্ছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে লেখাপড়া এবং পড়ার পরিবেশ আনন্দদায়ক করতে প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর শিক্ষকের কথা বললে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা নিয়োগ পাচ্ছে তারা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত। বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও বৃত্তিও দেওয়া হয়। এছাড়াও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ,স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ আরও সুযোগ সুবিধা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে।

    অপরদিকে কিন্ডারগার্টেনগুলোতে লেখাপড়া করা শিশুদের মাসে মোটা টাকা বেতন দিতে হয়, অতিরিক্ত বই কিনতে হয়। কিন্তু তারপরও কিন্ডারগার্টেনের প্রতি যে আস্থা জন্মেছে তা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে হচ্ছে না কেন। হলেও তা এত ধীর গতিতে কেন? প্রথমেই একটা প্রশ্ন আসে তা হলো প্রাথমিক বিদ্যালয় যারা চাকরি করেন তাদের সন্তানরা সবাই কি সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করে? এমনটা দেখা যায় যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা প্রায়ই এলাকার নামীদামী কোন কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়া করে। সবাই না তবে এই হারটাই বেশি হবে। তাহলে নিজের সন্তানকে যদি নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দিতে আস্থা না থাকে তাহলে অন্য অভিবাবকদের দোষ দিয়ে লাভ কি? এটা একটা কারণ মাত্র কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজেকেই করে দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে এটা করতে হবে। আমি কিন্ডারগার্টেনের উপর ভরসা করলে অন্যরা তা করবেই।

    শিক্ষাবান্ধব সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নীতকরণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে মিড ডে মিল কার্যক্রম অন্যতম। আশা করা যায় এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে এবং আগ্রহও বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে শিক্ষার মানে জোরারোপ করতে হবে। তাই শিক্ষকদের আন্তরিকতাও আরও একটু বৃদ্ধি করতে হবে।

    সহকারি শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে বেতন গ্রেড বৈষম্য দূরীকরণের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। তাদের সেই দাবি যৌক্তিক। যৌক্তিক এই দাবি পূরণ হলে তারা মানসিকভাবে আরও শক্ত হবে এবং তা প্রাথমিক শিক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। মূলত সবকিছু থাকা সত্তেও আন্তরিকতার ঘাটতি আজও রয়েই গেছে। আগে যে শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য কাজ করতে হয়েছে সংসার চালানোর চিন্তায়, এখন তো আর তা করতে হচ্ছে না। অন্তত আগের সেই চাপ আর নেই। তাই শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে একটু মনোযোগী হওয়া যায়। তবে আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে শিক্ষক সংকট। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সকল শিক্ষাস্তরের ভিত্তি। কতৃপক্ষও এ কথা স্বীকার করেছেন যে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার এই স্তরকে শক্তিশালী করতে সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর উপর আস্থা এবং কিন্ডারগার্টেন নির্ভর শিক্ষার প্রভাব কমাতে শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় এসব সুযোগ সুবিধা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। ধীরে ধীর এই স্তরের প্রতিটি ধাপ উন্নত দেশের মতো করা হবে সন্দেহ নেই। এসব শিক্ষার্থীর মাঝেই যে আগামী দিনের ভালো মানুষ লুকিয়ে থাকে। প্রাথমিক শিক্ষার যুগান্তকারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে মিড ডে মিল যে বড় ভূমিকা রাখবে।

    অলোক আচার্য
    সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
    পাবনা।

    বিএম/ প্রাথমিক শিক্ষায়