রোজিনা ইস্যুতে শুধু জাতিসংঘ নয়, আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমের উদ্বেগ

    শরিফুল হাসান ::

    সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। বিশ্ব সংস্থাটি বলেছে, বিষয়টির দিকে তারা নজর রাখছে। এটি স্পষ্টতই উদ্বেগের বিষয়। অবশ্য শুধু জাতিসংঘ নয়, আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমেই উদ্বেগের সাথে খবরটা প্রকাশ করেছে।

    নিজে সাংবাদিকতা করেছি বা করি বলে নয়, বাংলাদেশের সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে সরকারের সব নীতি নির্ধারকদের কাছে আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, আচ্ছা এই গ্রেপ্তারের ঘটনায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি বাড়লো না কমলো? এই যে সারা বিশ্ব আজ মনে করছে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা নিরাপদ নয়, বরং সাংবাদিকতা করতে গেলে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয় তাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে কেমন ধারণা তৈরি হলো?

    আজ একটা ভিডিওতে দেখলাম রোজিনা আপা মুচলেকা দিয়েছিলেন। ওই অবস্থায় পড়লে মুচলেকা দেয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আচ্ছা মুচলেকা দেয়ার পর মামলা করতে গেলেন কেন? আর রোজিনা ইসলাম তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন না। কাজেই তাকে সচিবালয় থেকেই কেন শাহবাগ থানায় পাঠাতে হবে? কেন সকালে আদালতে নিয়েই কারাগারে পাঠাতে হবে? এর চেয়ে মামলা তদন্তের সুযোগ দেয়া হতো।

    আমি মনে করি না এই ঘটনায় কোন মামলা হতে পারে। এতোটুকু ভিত্তি নাই মামলার। বোধ থাকলে যে কেউই সেটা বুঝবেন। যে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ এর যে ৩/৫ধারার কথা বলা হচ্ছে সেসব ধারা পড়েন তাহলে এটি পরিস্কার হবে যে, মূলত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যেন সরকারি কর্মকর্তারা বা অন্য কেউ জড়িত হতে না পারে সে কারণেই ব্রিটিশরা এই আইন তৈরি করেছিল।

    আইনটা পড়লেই বুঝতে পারবেন, মূলত সরকারি কর্মকর্তারা বা সাধারণ কোন মানুষ যেন সেনা, নৌ বা বিমান বাহিনীর কোন স্থাপনার নকশা, স্কেচ, মডেল, পরিকল্পনা, পাসওয়ার্ড বা তথ্য এগুলো ইত্যাদির গোপনীয়তা ঠেকাতেই এই আইন।

    আইনটা ধারবাহিকভাবে পড়লে বোঝা যাবে এখানে তথ্য প্রকাশ মানে বিদেশি শত্রুর কাছে সামরিক কোন তথ্য, নকশা, স্কেচ এগুলো প্রকাশ বুঝিয়েছে যাতে দেশের স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে পারে। আর এই আইনের ৩ ধারায় “গুপ্তচরবৃত্তির”যে কথা বলা হয়েছে, যা শুধুমাত্র তথ্য সংগ্রহ করে শত্রু দেশের হাতে তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

    রোজিনা আপা নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের সামরিক গোপন কোন তথ্য কোন শত্রুর কাছে যে প্রকাশ করেনি এটা তো পরিস্কার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় দাবি করেছেন, যে ফাইলগুলো সে নিয়েছে সেগুলো ছিলটিকা সংক্রান্ত। এগুলো গোপন নথি। রাশিয়ার সাথে যে টিকা চুক্তি করছি, চীনের সাথে চুক্তি করছি, এগুলো নন ডিসক্লোজার চুক্তি। এগুলো যদি বাইরে চলে যায় তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলাম এবং আমাদের তারা টিকা নাও দিতে পারে। এতে দেশের বিরাট ক্ষতি হতে পারে।’

    মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে প্রশ্ন, এতোই গুরুত্বপূর্ণ নথি যদি হয় যার কারণে টিকা আসবে না তাহলে এমন নথি অবহেলায় ফেলে রাখলেন কেন কর্মকর্তারা যার ফলে অন্যরা ছবি তুলতে পারে। তাহলে তো আগে এই কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি হওয়া উচিত।

    সবচেয়ে অবাক লাগল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মামলা করার আইন দেখে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল স্বীকৃতি অ্যাক্ট আইন প্রয়োগের নজির নেই। তাহলে
    রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে এই আইনে কেন মামলা হলো? আমি মনে করি মামলা বা গ্রেপ্তারের না গিয়েও এই ঘটনা শেষ হতে পারত। তারপরেও যদি ধরে নেই যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কারও গোয়ার্তুমির কারণে হয়তো মামলা হলো, তাই বলে কী তখুনি একজন সিনিয়র সাংবাদিককে জেলে পাঠাতে হবে?

    আইন অনুযায়ী ধরলাম মামলা হয়েছে। এবার তদন্ত হোক, আদালতে বিচার চলুক। সাজা হলে তাকে জেলে পাঠান। কারও বিরুদ্ধে মামলা হলেই তাকে জেলে পাঠাতে হবে? বিচার শেষ হওয়ার আগে যেন কেউ কোন ভোগান্তিতে না পড়েন কিংবা কোন শাস্তি না পান, সেটি নিশ্চিত করার জন্যই জামিনের বিধান রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে মামলার বিচারের আগেই কারও কারও জীবন কেটে যায় জেলে।

    অবশ্য আমি আশাবাদী আজ রোজিনা আপার জামিন হবে কারণ এটি জামিনযোগ্য মামলা। তবে আমি মনে করি সরকারের উচিত এই মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলবো, আপনারা যদি আসলেই দুর্নীতি বন্ধ করতে চান তাহলে সাংবাদিকদের কাজের সুযোগ দেন। আর পারলে জাতিকে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োগসহ নানা অনিয়ম যে হচ্ছে তার বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন আপনারা?

    এই যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়োগে কোটি টাকার দুর্নীতির খবর সেটা কী আপনারা স্বেচ্ছায় দিতেন? এই নিউজ ছাপার পর কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্যখাতে কী পরিমান হরিলুট হয়েছে? এখানকার পিয়ন, গাড়িচালকরাও কী করে কোটিপতি হয়?

    মনে রাখেবেন, সাংবাদিকতায় তথ্য চুরি করে বলেই আপনাদের এসব পুকুরচুরির খবর মাঝে মধ্যে জানতে পারে। তথ্য চুরি না করলে এই দেশের হাজোরো অনিয়ম-লুটপাটের ঘটনা মানুষ জানতো না। নীতি নির্ধারকদের বলবো, একটু ভাবেন গত ১২ বছরে বা গত ৫০ বছরে এই দেশে কী পরিমান দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে।

    এই যে বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক, ক্রেস্টে চুরি, স্বাস্থ্যখাতের লুটপাট, প্রতিটা নিউজেই কিন্তু দেশের উপকার হয়েছে। আমরা যদি চাই এসব লুটপাট বন্ধ করতে তাহলে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের উচিত সত্যিকারের সাংবাদিকদের সহায়তা করা।

    পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ সাংবাদিকদেরও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কিন্তু কোনদিন শুনেছেন কোন অসৎ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? হয়নি। কারণ সব পেশার সব অসৎরা একজোট। তারা সবসময় সত্যিকারের সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে চায়।

    ফলাফল দেখেন বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে দেখা বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫২তম। আফ্রিকার অনেক দেশ আমাদের আগে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশ, এমনকি আফগানিস্তান, পাকিস্তানেরও পেছনে।

    অবশ্য শুধু রাষ্ট্রীয় বা সরকারি বাঁধা নয় এই দেশের মালিক-সম্পাদকরা স্বাধীন সাংবাদিকতার আরেকটি বড় বাঁধা। এর প্রমাণ আমরা কিছুদিন আগে মুনিয়ার ঘটনায় দেখেছি।

    আরেকটা কথা। আমি ঢালাওভাবে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, ডাক্তার, সাংবাদিক বা কোন পেশার লোককেই গালি দিতে রাজি না। এই দেশের সব পেশায় ভালো মন্দ আছে।

    আমি বিশ্বাস করি জনপ্রশাসনের সব বিভাগে অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তা আছেন। একবার তাদের কথা ভাবেন। চারপাশে দুর্নীতি-অনিয়ম এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে সৎ মানুষরা সব জায়গায় কোনঠাসা। ধরেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তাহলে সেখানে কোন সৎ কর্মকর্তা থাকলে তার কী অবস্থা। তিনি কোথায় যাবেন?

    সরকারের সব দপ্তরেই একই অবস্থা। খারাপ মানুষগুলো একজোট, সৎরা কোনঠাসা।

    মনে রাখবেন আপনি পুলিশ সে কারণেই যদি পুলিশের অনিয়মকে সমর্থন করে থাকেন, আমলা বলে যদি আমলাতন্ত্রের সব অনিয়মকে সমর্থন করেন, সাংবাদিক বলে সাংবাদিকদের; তাহলে দেশ আর আগাবে না। আর আমাদের দেশের প্রতিটা দপ্তরের কী অবস্থা সেটা বুঝতে জ্ঞানী হওয়া লাগে না। আপনি ডিসি সাহেব, সচিব সাহেব কালকে সাধারণ নাগরিক পরিচয়ে সেবা নিতে যান, আপনি পুলিশ সাহেব সাধারণ পোষাকে একদিন থানায় যান, আপনি বিচারক সাহেব একদিন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আদালতে যান বুঝবেন ভোগান্তি কাকে বলে।

    এই অবস্থার পরিবর্তন কীভাবে হবে? আমি মনে করি সৎ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা এক্ষেত্রে আমাদের অনেক সহায়তা করতে পারে। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন থমাস জেফারসন একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি সরকারবিহীন সংবাদপত্র বেছে নেব।

    অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।

    হ্যা সব পেশার মতো বাংলাদেশের সাংবাদিকতার অবস্থাও ভালো না। আসলে সংবাদপত্র বা টেলিভিশনকে যদি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বানানো না যায়, যদি সত্যিকারের মালিক আর সৎ সাংবাদিক এই দুই একসাথে না হয়, তাহলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ভবিষ্যত খুব আশাব্যঞ্ছক নয়। এর মধ্যেও যদি পেশাদার সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয় তাহলে যেটুকু আছে সেটুকুও কী থাকবে?

    আজকে যারা ভাবছেন সাংবাদিকতা না থাকলে সমস্যা কী, তাদের বাংলাদেশের হাইকোর্টের গত বছরের একটা কথা মনে করিয়ে দেই। কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফ বনাম ডিসি সাহেবের মামলায় হাইকোর্ট বলেছিল, সাংবাদিকরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করত পারে, তাহলে রাষ্ট্রের বাকি তিন স্তম্ভ (আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কী না সেটা দেখার কেউ থাকবে না।

    আমি সবসময় বিশ্বাস করি সত্যিকারের সাংবাদিকতা শুধু একটা ব্যক্তির জীবন না সমাজ ও রাষ্ট্র বদলে দিতে পারে। দেখেন এই যে আমি বলতে পারি আমার ৩৮ বছরের জীবনে অন্তত ৩৮ হাজার মানুষের সেবা বা উপকার আমি করেছি, সেটা আমার সাংবাদিকতার কারণেই বলতে পারি।

    তবে একটা জিনিষ আমি সবসময় মনে রাখি, হবে আপনি যে পেশারই মানুষ হন, সততা খুব জরুরী। সৎ মানে শতভাগ সৎ। নয়তো সত্যিকারভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেন না।

    শেষ কথা বলি। একটি সুন্দর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আসলে প্রয়োজন সর্বত্র সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিকরণ। সেটা থাকলে এই দেশে চুরিও হতো না, আবার চোরের মায়ের বড় গলাও হতো না। যতোদিন সেটা না হচ্ছে ততোদিন সাংবাদিকতা খুব প্রয়োজন। আর সুশাসন আসার পরেও দরকার সাংবাদিকতা যাতে সেই সুশাসন টিকে থাকে। আমি চাই রোজিনা আপা মুক্তি পাক। কোনঠাসা সব সৎ মানুষেরা ভালো থাকুক। পরাজয় হোক সব অসৎ মানুষের। জয় হোক সাধারণ মানুষের। ভালো থাকুন সবাই। ভালো থাকুক বাংলাদেশ।

    লেখক : শরিফুল হাসান, সিনিয়র সাংবাদিক