যতোটা গুরুত্বহীন সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়

ওয়াহিদ জামান ::

অন্যান্য পেশার সাথে সাংবাদিকতা সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্য বেশি। সাংবাদিক ও সাংবাদিতার জগতে ‘ মানসিক স্বাস্থ্য ‘ বিষয়টি ততটাই গুরুত্বহীন, যতটুকু গুরুত্ব ভিন্ন পেশায় রয়েছে৷ নিউজরুমের ভেতরে বাইরে, মাঠে সবখানেই মানসিক চাপের মধ্যেই কাজ করতে হয় সাংবাদিকদের।

তথ্যের সত্যতা, সোর্সের বিশ্বাসযোগ্যতা হতে শুরু করে সংবাদ ডেলিভারির প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানসিক চাপ নিয়ে পেশায় টিকে  থাকতে হয়।  সেই চাপের ভাগ নেয় না নিউজ এডিটর, এসাইনমেন্ট এডিটর কিংবা এইচআর। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য ও অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ ‘ সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ‘।

ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা, পেশাগত বিষণ্নতা, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস, ডেটলাইনের চাপ,  অনিদ্রা- নিউজরুমের ভিতরে এবং বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক একটি অনুষঙ্গ । অনুসন্ধানী টিমের  সাংবাদিকতা,  এবং অপরাধ বিটের প্রতিবেদকরা যারা সমাজের অসংগতি , সততার বিপর্যয়,  দূর্নীতি  এবং সংঘাত কভার করে তাদের  মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলির বিকাশের ঝুঁকি অনেকটাই বেশি ।

সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্য একটি লোক দেখানো ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয় আমাদের দেশে । মানসিক চাপকে পেশার অংশ এবং পার্সেল হিসাবে বিবেচনা করা হয়, বা মানসিক চাপকে নিউজরুম সংস্কৃতির একটি ডিফল্ট অবস্থা হিসাবে বিবেচনা করা হয় অধিকাংশ মিডিয়া হাউজে। নিশাচর সময়সূচী, সংবাদ কাভার কঠোর সময়সীমা এবং সম্ভাব্য বিপজ্জনক রিপোর্টিং এর মাঠ পরিবেশ,  অবকাঠামোগত সমস্যা,  যাতায়াতের দূর্ভোগের মত ‘মানসিক চাপ’ অতি সাধারন ঘটনা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য৷

বাংলাদেশে মফস্বলে কর্মরত সংবাদকর্মী, বিভাগীয় শহর দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের মানসিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

এমন রিপোর্টার এবং তাদের প্রধান কার্যালয়ের  মধ্যে শারীরিক দূরত্বের কারণে, মফস্বল  সাংবাদিক এবং জেলা সংবাদদাতাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় কোন স্থায়ী বা অস্থায়ী মানসিক পরিষেবা নেই সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন  গণমাধ্যমগুলোর।

গণমাধ্যমকর্মীদের এমন সমস্যাকে ঘিরে আমাদের দেশে গবেষণার পরিসর সম্মৃদ্ধ নয়। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী   মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাঘাত সাংবাদিকতার বৃত্তে খুব কমই স্বীকার করা হয়। মানসিক ট্রমাকে স্বীকার করতে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের  অনীহা শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে নয়, বরং বেকারত্বের বাস্তব ভয়ের কারণেও।

বাংলাদেশ পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা আছে এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ৬৫ লাখ। এই সংখ্যার মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীরা অন্তভূক্ত কিনা সেটি পরিস্কার নয়। তবে কোন ধরণের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলে এক জন মানুষ প্রাণ নাশের মতো সিদ্ধান্ত নেন, সে নিয়ে রয়েছে নানা ধরণের মতামত ও অভিজ্ঞতা।

১৩ জুলাই রাজধানীর হাজারীবাগের বাসা থেকে সাংবাদিক সোহানা তুলির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন সোহানা তুলি। তিনি দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক কালের কণ্ঠেও কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলা ট্রিবিউনে কর্মরত ছিলেন। সোহানা তুলি ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। সাব-এডিটর কাউন্সিলেরও সদস্য ছিলেন তিনি। পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্টেও আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে। সোহানা তুলির আত্মহননের ঘটনা সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের বিষয়টি নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে৷ কারণ আত্মহত্যার প্রবণতা এমন একটি সমস্যা যা মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত।

মানসিক স্বাস্থ্য এবং সাংবাদিকদের নিজস্ব সুস্থতার  কভারেজ ঐতিহ্যগতভাবে গণমাধ্যম  শিল্পে উপেক্ষা করা হয়েছে। যদিও সংবাদকর্মীরা  কাজের ক্ষেত্রে প্রায়শই অবিশ্বাস্য ট্র্যাজেডি এবং ট্রমার সাক্ষী হন৷ পেশাগত জীবনে ব্যস্ত সময়সূচী মোকাবেলা করেন, চাকরির ক্ষেত্রে  অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হন, তবুও  কাজ করেন অস্বাস্থ্যকর নিউজরুমে।

বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনদিন ধরে মাঠে কাজ করা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিরবিচ্ছিন্ন কর্মঘন্টা আর আগুনে পোড়া মরদেহের মুখোমুখি হয়ে অনেকেই শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ভুগেছেন। কিন্তু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেখা যায় কাউকেই। মিডিয়া হাউজগুলোর প্রধান কার্যালয় থেকেও ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থেকে কাজ করা এসব সাংবাদিকের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ নেবার কোন উদাহরণ চোখে পড়েনি।

প্রায় ১০০০ কানাডিয়ান মিডিয়া কর্মীদের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে আসে ৬৯ % উদ্বেগ এবং ৪৬ % বিষণ্নতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। ৫৩ শতাংশ পেশাগত চাপ এবং মানসিক সুস্থতা মোকাবেলা করার জন্য চিকিৎসকদের শরণাপন্ন  হয়েছেন ।

সম্প্রতি ICMF  প্রকাশিত একটি সমীক্ষায়, উত্তরদাতাদের ৭০ শতাংশ  কোভিট সময়কালকে বিবেচনা করেছেন তাদের কাজের মধ্যে সহ্য করা সবচেয়ে কঠিন সময় হিসাবে। COVID-19 সংকট মোকাবেলার মানসিক এবং মানসিক প্রভাবকে মূল্যায়ন করেছেন সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা । সমান্তরালভাবে, রয়টার্সের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংবাদিক COVID-19 নিয়ে রিপোর্ট করছেন উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার লক্ষণ নিয়ে।  ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টের  ( IFJ) জরিপে দেখা যায় মহামারী চলাকালীন সময়ে  গণমাধ্যমকর্মীদের তিন চতুর্থাংশের (মহিলা) মানসিক চাপের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সৌভাগ্যবশত, সাংবাদিকদের মানসিক দূর্যোগ মোকাবেলার অনেক ইতিবাচক দক্ষতা রয়েছে যা  কঠিন অভিজ্ঞতায় রপ্ত করা।

মানসিক বিপর্যয় ঠেকাতে কঠিন পরিস্থিতিতে  সহকর্মীদের সাথে শেয়ারিং, জার্নালিং বা অন্যান্য স্ব-প্রতিফলিত অনুশীলন, নিয়মিত ব্যায়াম,  স্বাস্থ্যকর খাদ্য  এবং ব্যক্তিগত সাইকোথেরাপিতে বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যদিও একজন সাংবাদিকের অনুভূতিগুলি পরীক্ষা করার জন্য একটি সুরক্ষিত স্থানের প্রচন্ড অভাব রয়েছে গণমাধ্যমগুলিতে।

একজন পেশাদার সাংবাদিকের আবেগের সাথে তার মানসিক স্বাস্থ্যের সীমানা সুরক্ষায় কার্যকর উদ্দ্যেগ গ্রহন করা জরুরি। নিজের এবং অন্যদের সাথে স্পষ্ট সীমানা নির্ধারণ করে ঘরের জীবন থেকে কাজকে আলাদা করতে সাহায্য করা।  বিপরীতে, মানসিক সুস্থতার সীমানা অস্পষ্টতার মধ্যেও কেউ অনুভব করতে পারে যে  “ভালো সাংবাদিক” হিসেবে গল্পটি পাওয়ার জন্য “যাই লাগে” করবো। সাংবাদিকদের মানসিক  সংকটের মূখ্যতা তাদের  জীবনে অন্যান্য প্রয়োজন এবং সম্পর্কের গুরুত্বকে কমিয়ে দেয়। যখন সীমানা অস্পষ্ট হয়, তখন আমরা যা পছন্দ করি, তা আমাদের ভালোভাবে পরিবেশন করতে পারি না।  আমাদের প্রকৃত অগ্রাধিকারকে ম্লান  করে দেয়। এই সীমানা দৃঢ়ভাবে অক্ষত রাখতে,  কাজের বাইরে সময় তৈরির করার কথা বিবেচনা আনা উচিত । যদিও এটি প্রাথমিকভাবে এমন সময় চিহ্নিত করা  কঠিন হতে পারে। দৈনিক, মাসিক এবং বার্ষিক সম্পূর্ণভাবে কাজ-মুক্ত সময় আলাদা করা, এটি সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।

সাংবাদিকতার জগতে এমন অংশীদার থাকা জরুরি, যে বা যারা আপনাকে সময়ের সাথে সাথে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সামনে আসা নতুন অনুসন্ধানের ইস্যু, প্রতিবেদন তৈরির আইডিয়া, গোপন কোন সুত্রের সন্ধানের মতো সুযোগগুলি বিবেচনা করতে সহায়তা করবে । মানে হলো নিউজরুমের আশেপাশে বা সাংবাদিকতার জগতে  মানসিক নির্ভরতার পকেট তৈরি করা। অন্যের মর্মান্তিক বর্ণনামূলক গল্প শোনার এবং পুনরায় বলার ফলে সমান্তরাল ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে জেনেও সাংবাদিকদের ঝুঁকি নিতে হয়। তাই কর্মক্ষেত্রের সকল চাপের মুহূর্তে ‘ আমি কেমন অনুভব করছি?” শেষ প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া প্রয়োজন।