নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা
টোকেন বাণিজ্যে মাসে কোটি টাকা চাঁদাবাজি, চলে জুয়া মাদক ও পতিতাবৃত্তি

বাংলাদেশ মেইল ::

লাইন নিয়ন্ত্রণের নামে টোকেন দিয়ে চট্টগ্রাম নগরে পাঁচ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে মাসে ৭০ থেকে ৯০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে একটি চক্র। চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। তাছাড়া সিএনজি ট্যাক্সির নিয়ন্ত্রণ অফিসে চলে জুয়া, মাদক ও পতিতাবৃত্তি। যার ফলে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের ম্যানেজ করে চলছে নানা অপকর্ম।

গত কয়েকদিন ধরে কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় গেলে নানা পাওয়া যায়।

তথ্যমতে, নগরীর প্রবেশদ্বার চান্দগাঁও থানার মোহরা কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় থেকে এসব অটোরিকশা উপজেলা শহর ও বিভিন্ন গ্রামে যাতায়াত করে। ফলে অটোরিকশার লাইন নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি চলে অস্ত্রের মহড়া। তাদের হাতে জিম্মি চালকরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের জেলার রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, কাপ্তাই ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন যানবাহন যাত্রী নিয়ে আসে রাস্তার মাথা মোড়ে। সেখান থেকে যাত্রীদের নিয়ে উপজেলা শহর ও বিভিন্ন গ্রামে যান অটোরিকশা চালকরা। মূলত এই রাস্তার মাথা মোড় পর্যন্ত অটোরিকশা আনতে মাসে ৯০০ টাকা চাঁদা দিয়ে টোকেন নিতে হয় চালকদের। এর বাইরে রাস্তার মাথা মোড় থেকে যতবার যাত্রী নেবে ততবারই ১০ টাকা করে দিতে হয় লাইন নিয়ন্ত্রকদের।
পাঁচ মাস আগে কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় এলাকায় অটোরিকশার লাইন নিয়ন্ত্রণ করতেন হাসান, ভুট্টু ও সোহেল রানাসহ ২০ জনের একটি গ্রুপ। সম্প্রতি তাদের মারধর করে ওই স্থান থেকে তাড়িয়ে তা নিয়ন্ত্রণে নেন মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও তার নিজস্ব সন্ত্রাসী গ্রুপ। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় অপকর্ম করায় সম্প্রতি অস্ত্র ও মাদকসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জেল থেকে বের হয়েও এ সড়কের চাঁদাবাজি একক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সাথে স্থানীয় পুলিশ ও ট্রাফিক সদস্যদের ম্যানেজ করে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে বলে বেশ কয়েকজনে জানিয়েছেন।

২০২২ ও ২০২৩ সালে অর্থাৎ, এ দুই বছরে লাইন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ১০ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ২০ জনের বেশি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার সিএনজি চালিত অটোরিকশা। এসব নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশ নেই। গুরুত্বপূর্ণ এই মোড়ের অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করছে এক শ্রেণির ‘লাঠিয়াল বাহিনী’। লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যদের কথায় চলে মোড় থেকে সিএনজি অটোরিকশা। দেখে মনে হচ্ছে আলাদা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে লাঠিয়াল বাহিনী। অটোরিকশার লাইন নিয়ন্ত্রকদের হয়ে কাজ করছেন লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরা। নিয়ন্ত্রণের কাজে রয়েছেন ১৫-২০ জন সদস্য। এর মধ্যে কেউ যেসব অটোরিকশা যাত্রী নিয়েছে সেগুলো থেকে ১০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন। কেউ মাসিক টোকেনের মেয়াদ আছে কি না তা দেখছেন। আবার কেউ গাড়ির সিরিয়াল করে দিচ্ছেন। কোনও চালক টাকা কম দিলে তাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ফেলে লাঠি দিয়ে মারধর করা হচ্ছে।

শুধু সিএনজি ট্যাক্সি থেকে চাঁদা নেয়া হয়, তা কিন্তু নয়। এখানে জুয়ার বোর্ড থেকে দৈনিক আয় হয় ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। তাছাড়া জুয়ার বোর্ডের পাশাপাশি এখানে চলে মাদকের আসর। বেচাকেনা হয় ইয়াবা, গাজা, হিরোইন, আইসসহ পতিতাবৃত্তিও। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাকে মাসোহারা দেয়া হয় বিধায় পুলিশ দেখেও অন্ধ।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এগুলো এখানে প্রতিদিনের দৃশ্য। যানবাহনের শৃঙ্খলার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করছেন লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরা। তাদের কথায় চলছে এখানের সব সিএনজি অটোরিকশা। তাছাড়া জুয়া, মাদক ও পতিতাবৃত্তির টাকা থানা পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের পকেটে যায় বিধায় তারাও কোনো পদক্ষেপ নেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন চালক অভিযোগ করে বলেন, ‘রাস্তার মাথা থেকে যতবার যাত্রী নিই ততবারই ১০ টাকা করে দিতে হয় আমাদের। এছাড়া প্রতি মাসে ৯০০ টাকা দিয়ে টোকেন নিতে হয়। তা নাহলে রাস্তার মাথা মোড় থেকে যাত্রী তুলতে দেওয়া হয় না। যেসব অটোরিকশাচালক টোকেন নেননি সেগুলোকে ট্রাফিক পুলিশকে দেখিয়ে দিয়ে মামলা দিয়ে দেন লাইন নিয়ন্ত্রণকারীদের সদস্যরা। আবার তারা দেখিয়ে দিলে সেসব অটোরিকশা জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ। কিন্তু আগে যারা লাইন নিয়ন্ত্রণ করতেন, তারা ৬০০ টাকা নিতেন। কোনো হয়রানি করতেন না। বর্তমানে নিয়ন্ত্রকদের জ্বালায় আমরা অতিষ্ঠ। কোন চালক যদি হোসেনের অপকর্মের বিষয়ে প্রতিবাদ করে, তবে ওই চালককে মিথ্যা মামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করেন। আমরা এর থেকে প্রতিকার চাই।’

আলী আহমদ নামের এক চালক বলেন, ‘কাপ্তাই রাস্তার মাথা মোড় থেকে দিনে সাত হাজারের বেশি অটোরিকশা যাত্রী নিয়ে আসা-যাওয়া করে। সে হিসাবে সাত হাজার অটোরিকশা থেকে একবার ১০ টাকা করে নিলে দিনে ৭০ হাজার টাকা, মাসে ২১ লাখ টাকা। মাসে ৯০০ টাকা টোকেন দিয়ে সাত হাজার অটোরিকশা থেকে চাঁদা নেওয়া হয় ৬৩ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে মাসে ৮০-৯০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করে তারা, আর এসব চলে হোসেনের (আবুল হোসেন) ইশারায়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, ‘সিএনজি অটোরিকশার লাইন নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি চলে অস্ত্রের মহড়া, জুয়া, মদ-গাজাসহ মাদকের আসর এবং পতিতাবৃত্তি। আর পুলিশ আসলেও যেন কিছুই করেন না। কারণ থানাকে প্রতিমাসে ৫ লাখ টাকার মত মাসোহারা দেন বলে লাইনম্যানদের মুখে শুনেছি।’

জুয়া ও মাদকের আসর নিয়ে স্থানীয় ব্যক্তি আহাদ হোসেন বলেন, ‘প্রতিদিন হোসাইনের অফিসে জুয়ার বোর্ড চলে। দৈনিক লেনদেন হয় লাখ টাকারও বেশি। পাশাপাশি মাদক সেবন চলে মাত্রাতিরিক্ত। সেবনের পর গালাগালি এবং মাতলামির কারণে আমরা এলাকায় থাকতে পারি না।’

এসব বিষয়ে অস্বীকার করে মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা নির্দয়ভাবে চালকদের কাছ থেকে টাকা নিই না। এগুলো সব মিথ্যা কথা। আমরা অবৈধ কিছু করলে পুলিশ-প্রশাসন আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক মাসের প্রতি অটোরিকশা থেকে টোকেন প্রতি ৫০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হয়। এখানে অনেক খরচ আছে। এই টাকা দিয়ে এসব খরচ মেটানো হয়।’

টোকেন দিয়ে চাঁদা আদায় সম্পূর্ণ অবৈধ বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর অটোরিকশা-অটো টেম্পো মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এটি মূলত চাঁদাবাজি। এসব চাঁদাবাজি বন্ধে প্রশাসনের কাছে আমরা একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু প্রশাসন এসব চাঁদাবাজি বন্ধে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। প্রকাশ্যে টোকেনের মাধ্যমে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যে শুধু স্থানীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত, তা কিন্তু নয়। স্থানীয় থানা ও ট্রাফিক পুলিশও জড়িত। এজন্য আমরা অভিযোগ দিলেও কোনও ব্যবস্থা নেয় না পুলিশ।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রাস্তার মাথা এলাকায় টোকেনের বিনিময়ে অটোরিকশা থেকে চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। টোকেন দিয়ে চাঁদা নেওয়ার বৈধতা কাউকে দেওয়া হয়নি। এটি সম্পূর্ণ চাঁদাবাজি। বিষয়টি সম্পর্কে স্থানীয় থানা পুলিশ এবং সিএমপির ক্রাইম ডিভিশন ভালো বলতে পারবে। তবে যানবাহনের কোনও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তা আমরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো।’

চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল কবির বলেন, ‘ অভিযোগ পাবার পর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। কিন্তু কেউ তো অভিযোগ করে না। লাইন নিয়ন্ত্রণের নামে টোকেন বাণিজ্যের অভিযোগে ইতিমধ্যে র্যাব বেশকিছু চাঁদাবাজকে আটক করেছে। পুলিশ নজর রাখছে। ‘

রাস্তার মাথা এলাকায় দায়িত্বরত সিএমপির ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) কামরুজ্জামান রাজ বলেন, ‘ এমন অভিযোগ আগে ছিলো। বর্তমানে অবৈধ সিএনজি যেমন চলাচল বন্ধ, তেমনিভাবে সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে দেয়া হচ্ছে না। ‘

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে সড়ক পরিবহন আইনের ৭৭ নম্বর ধারায় অনুযায়ী অবৈধ  গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ট্রাফিক পুলিশের। সড়ক পরিবহন আইনের ৭৭ নম্বর ধারায় বলা আছে রুট পারমিট ব্যতীত পরিবহন যান চালনা বা চালনার অনুমতি দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সিএমপির পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়  বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা এইসব অনিয়মের সাথে জড়িত থাকায় এই নৈরাজ্যের তথ্যগুলো পুলিশ হেড কোয়াটার্স পর্যন্ত পোঁছায় না ; অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।