পদ্মা সেতু নিয়ে রহুল আমিনের অভিজ্ঞতা

পদ্মা সেতু নিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব লেখালিখি হচ্ছে।প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে সেতুর নানান বিষয় নিয়ে নিউজ হচ্ছে।পদ্মা সেতু নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে, হয়তো সামনে আরও হবে।সেতুর নির্মান ব্যয়,লোন, নির্মানকাল ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা চলছে।এই সেতু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় কি ধরনের পরিবর্তন ঘটবে সেই আলোচনাও হচ্ছে।পদ্মা পার হতে কত সময় লাগবে সেই সংবাদও গণমাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়েছে।পদ্মা সেতু দেখতে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ পদ্মাপাড়ে ভিড় জমাচ্ছেন। অনেকেই পদ্মা সেতুর সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছেন।পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারনের পর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে,ইতিপূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে সরকার কর্তৃক নতুন করে কোনো টোল, কর, ফিস, সেস বা যেকোনো শুল্ক/ফি ইত্যাদি আরোপ করার পর সাধারণের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
২.
অগণিত মানুষ যারা নিয়মিত কিংবা অনিয়মিত ফেরি, লঞ্চ, স্পীডবোট কিংবা ট্রলারযোগে এই পদ্মা পার হয়ে বাড়ি ফিরেন কিংবা বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যান তারা খুব ভালো করেই অনুধাবন করতে পারবেন কত কষ্ট, কত ভোগান্তি, কত ঝুঁকি আর কত সময় অপচয় করে পদ্মা পার হতে হয়।সকালের বাসে যারা ঢাকা যেতেন তাদের অনেককেই দেখেছি সতর্কতা হিসেবে সাথে খাবারদাবার নিতে,কারন ঠিক কতক্ষণে গন্তব্যে পৌছবেন সেটা বলা মুশকিল।মোটা দাগে পদ্মা পাড়ি দিয়ে বাস যাত্রা ছিল এরকম – বাস এসে পদ্মার পাড়ে কাছাকাছি কোথাও থামবে এরপরে বাস থেকে নেমে দীর্ঘ পথ হেটে লঞ্চে উঠতে হবে,ফের লঞ্চ থেকে নেমে দীর্ঘ পথ হেটে আবার বাসে উঠতে হবে,এসময় যদি কেউ ভুল করে পথ হারিয়ে ফেলেন তাহলে বাস মিস।অনেক সময় বাস থেকে নেমে রিক্সায় করে লঞ্চঘাট পর্যন্ত যেতে হয়েছে কারন নদীতে পানি কম বা বেশির কারনে লঞ্চঘাটের স্থান পরিবর্তন হতে দেখেছি।যদি সাথে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে লঞ্চে পদ্মা পার হতে হয় তাহলে কোলে বা এক হাতে বাচ্চা অন্যহাতে ব্যাগ নিয়ে সাবধানে হাটতে হবে,ব্যাগ সামলাবেন নাকি বাচ্চা?? সে এক যুদ্ধ!এধরনের যাত্রায় ইচ্ছে থাকলেও সাথে একাধিক লাগেজ নেয়ার সুযোগ থাকে না,দুই হাতে আর কয়টাই বা লাগেজ নেয়া যায়।লঞ্চে ওঠানামায় ঠেলাঠেলিতে নদীতে যাত্রীদের পড়ে যেতে দেখেছি,ভীড় ঠেলে লঞ্চে উঠে লাগেজ কোথায় রাখবেন সেই জায়গা খুঁজতে হয়, লাগেজ শুধু রাখলেই হবেনা লাগেজে চোখও রাখতে হবে কারন কেউ একজন আপনার লাগেজ নিয়ে নদীতে ঝাপ দিতে পারে,লাগেজ রাখলেন বাচ্চাকাচ্চা আর পরিবারের সদস্যরা কই দাঁড়াবে সেটাও খুঁজে বের করতে হবে,এরপরে আবার একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চ থেকে নামতে হবে,নামতে গিয়ে আপনি লাগেজ,বাচ্চা নাকি একটা বাঁশ ধরে নামবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে পেছন থেকে যাত্রীদের চাপ আসবে,ভাই দ্রুত করেন,এরমধ্যে পেছনে তাকালে দেখা যাবে বাচ্চার মা’কে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা,ধাক্কাধাক্কিতে হয়তো অন্য দিকে চলে গেছে।ফেরি পারাপারে যেতে চাইলে ঘাটে আসার সাথে সাথেই ফেরি পাবেন তার নিশ্চয়তা নাই।ফেরি পেতে কতক্ষন লাগবে তারও কোনো সঠিক হিসাব কারো জানা নাই।এই দীর্ঘ অপেক্ষা বা দীর্ঘ যাত্রায় শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে খুবই কম বিশেষ করে নারী যাত্রীদের।এই হিসাব স্বাভাবিক সময়ের জন্য।রোযা কিংবা কোরবানি ঈদের ছুটিতে এই যাত্রার হিসাব আরও ভোগান্তির।এতসব ভোগান্তির সাথে বাড়তি যোগ হতো আতংক। আতংকের নাম “অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই লঞ্চে পারাপার”। একবার এক লঞ্চের চালককে বিনয়ের সাথে বলেছিলাম,এত মানুষ নিচ্ছেন কেন লঞ্চ ত ডুবে যাবে! উত্তরে তিনি খুব স্বাভাবিক ভঙিতে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, বেশি ভয় পেলে যেনো ব্যক্তিগত লঞ্চে যাতায়াত করি।রাতে জরুরি প্রয়োজনে পদ্মা পার হতে হলে ফেরি না পাওয়া গেলে,স্পীডবোট বা ট্রলারই ভরসা,শীতকালে সেই যাত্রায় ঝুঁকি কম হলেও,বর্ষাকালে অনেকটা মৃত্যু ঝুঁকিকে আলিঙ্গন করার শামিল।স্পীডবোট বা ট্রলার মাঝ নদীতে নষ্ট হয়ে যাবার ঘটনাও স্বাভাবিক ও নিয়মিত ছিল। রাতে বাড়তি ভাড়ার এ যাত্রায় পথ চলতে স্পীডবোটের আলো বলতে চালকের হাতে থাকা টর্চ লাইট। অতিরিক্ত যাত্রীর কারনে লঞ্চ ডুবেডুবে অবস্থায় কতবার যে সৃষ্টিকর্তার দয়ায় পদ্মা পার হয়েছি তার হিসাব নাই,প্রবল বাতাসে লঞ্চ একবার এপাশে আরেকবার ওপাশে কাত হয়ে যাচ্ছে আর সবাই সমস্বরে ভয়ে চিৎকার করে উঠছে।আমি সবসময় লঞ্চের দোতলায় বা ছাদে বসতাম যেনো লঞ্চ ডুবতে বসলে অন্তত ঝাপ দিয়া পানিতে পড়তে পারি।আর ঝড় তুফানের মাসে লঞ্চে কেন ফেরিতেও পারাপার হতে ভয় লাগতো। শীতে ঘন কুয়াশায় ডুবোচরে ফেরি বা লঞ্চ আটকে গেলে,সেখান থেকে মুক্তি পেতে কত সময় খরচ হয়ে যেতো সেই হিসাব না হয় বাদই থাকুক।এছাড়াও ঘন কুয়াশার কারনে ফেরি বা লঞ্চ চলাচল যখন বন্ধ হয়ে যেতো,তখন দুই পাড়ের সারি সারি গাড়িকে সূর্যি মামার জন্য অপেক্ষা করতে হতো।প্রায়শই মনে হতো যারা লঞ্চে যাত্রী পারাপার করেন তাদের ধারনা যতক্ষণ না লঞ্চ ডুবে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত যাত্রী নেয়া যাবে।ডুবে গেলেই ধরে নিতে হবে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া হয়েছিলো।অতিরিক্ত যাত্রী নেবার প্রবনতা কখনোই কমতে দেখিনি।অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করার কারনে লঞ্চ বা ট্রলার ডুবির ঘটনায় প্রিয়জনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।এরকম কত শত আতংক আর তিক্ত ও কষ্টের অভিজ্ঞতা এই পদ্মা পারাপার নিয়ে।সংকটাপন্ন রোগী বহনকারী এম্বুলেন্স কে এ ঘাটে এসে ফেরির জন্য ছোটাছুটি করতে দেখেছি। একবার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোটো ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে পদ্মার পাড়ে ফেরির জন্য ৩/৪ ঘন্টা বসে ছিলাম।টোল,নির্মান ব্যয়,প্রবৃদ্ধি, জিডিপি, সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে এবং হবে।এই আলোচনার বাইরেও পদ্মা পারাপারের সীমাহীন ভোগান্তি, কষ্ট,আতংক আর অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির স্বপ্ন পূরণের আনন্দও আছে।কারো কারো কাছে পদ্মা সেতু মানে কষ্ট আর ভোগান্তি থেকে মুক্তির স্বপ্ন পূরণ, প্রিয়জনের স্বস্থির যাত্রার লালিত স্বপ্নপূরণ।
৩.
পদ্মা সেতু নিয়ে গুজবও বেশ ডালাপালা ছড়িয়েছে, সেই গুজব আতংকও ছড়িয়েছে ।”মানুষের কল্লা কেটে পদ্মা ব্রিজের পিলারের গোড়ায় দিতে হবে” গুজবটি বেশ ভুগিয়েছেও।একবার এক স্কুলে গিয়ে জানা গেলো,মায়েরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না।কারন হিসেবে এক শিক্ষক জানালেন,ছেলেধরা যদি তার বাচ্চাকে নিয়ে যায় এই ভয়ে মায়েরা ঝুঁকি নিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে যেতে দিচ্ছেন না। গুজব বোধহয় শেষ হয়নি। গুজব এখনো আছে।গুজব আছে টোল আদায়কারী নিয়ে,গুজব আছে টোলের টাকা কই যাবে সেটা নিয়েও।গুজব ছিল, আছে, হয়তো সামনে থাকতেও পারে।গুজব মাড়িয়ে, সব ছাপিয়ে পদ্মা সেতু আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকুক এবং যার দৃঢ়তায় ও আন্তরিকতায় কোটি মানুষের ভোগান্তি লাঘব হলো তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

লেখক :
মোহাম্মাদ রুহুল আমিন
সচিব(ভারপ্রাপ্ত),বাংলাদেশ চা বোর্ড।