সওজ'র পিন্টু চাকমা প্রতিদিন পাবেন ২০ হাজার
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে দেয়া হচ্ছে কালুরঘাট ফেরির ইজারা

নিয়াজ তুহিন 

চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু সংস্কার কাজ চলার কারণে কর্ণফুলী নদী পারাপারে ফেরি ঘাট ইজারার দরপত্র আহবান করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এখন পর্যন্ত সাতবার টেন্ডার আহবান করার পরও ‘ আমরিন এন্টারপ্রাইজ ‘নামের একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানকে ফেরি ইজারা দিতে বার বার রি টেন্ডার করছে সংস্থাটি, এমন অভিযোগ ও কানাঘুঁষা চট্টগ্রামের সড়ক ভবনে।  সর্বশেষ ২৪ শে আগস্ট ওপেন করা টেন্ডারে সওজ’র পছন্দের প্রতিষ্ঠান আমরিন এন্টারপ্রাইজ  দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হয়। সাতবার টেন্ডার আহবান করা হলের  প্রতিষ্ঠানটি প্রথম বারের মতো দরপত্র জমা দিয়েছে।

মুল্যায়ন কমিটি গঠন ও মুল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরির কাজ সম্পন্ন না হলেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা আমরিন এন্টারপ্রাইজের মালিক মনসুর আলম পাপ্পী  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে ফেরি ঘাটটির  ইজারাদার হিসেবে ঘোষণা দিয়ে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের সচিব আমানুল্লাহ নুরী প্রতি।  সচিবের সাথে সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ে তোলা নিজের ছবি  ফেসবুকে পোস্ট দেন।

নিজের ফেসবুক ওয়ালে পাপ্পী লিখেছেন , আলহামদুল্লাহ সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিনুল্লাহ নূরী ভাইজানের সাথে সৌজন্য স্বাক্ষাতে আগামী তিন বছরের জন্য কালুরঘাট ফেরি নিয়ে সর্বোচ্চ দরপত্রদাতা হিসেবে আমি মনসুর আলম পাপ্পীর সত্ত্বাধিকারী  আমরিন এন্ড ব্রাদার্সকে আন্তরিকভাবে নেয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চট্টলার মানুষের সেবা করার প্রয়াসের জন্য যেন পূর্ণতা পেলাম। আলাপনী মুহুর্তে সাথে ছিলেন দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রয়াদ সাংসদ দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি এমপি মোসলেম উদ্দিন আহমেদ এর সুযোগ্য কণ্যা স্নেহের ভাতিজি সুমী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ধর্ম বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য আরিফ, আমার একমাত্র মেয়ে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার আকিকা আমরিন এবং মেয়ে জামাই আমার ছেলে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার শিহাব। ‘

২৭ শে আগস্ট বিকাল তিনটায় নিজের ফেসবুক পেজে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সচিব আমিনুল্লাহ নুরীকে ‘ভাইজান’ সম্মোধন করে ফেরিঘাট ইজারা নিশ্চিত করার ঘোষণা দেন মনসুর আলম পাপ্পী । ফেরি ইজারার বিষয়ে  সচিবের সাথে নিজের বৈঠক ও ইজারা প্রাপ্তির জাহির করতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের   সচিব একেএম আমিনুল্লাহ  নুরীর কার্যালয়ে তোলা একটি ছবিও পোস্ট করেছেন। সেই ছবিতে চট্টগ্রামের  বোয়ালখালীর প্রয়াত সাংসদ মোসলেম উদ্দিন চৌধুরীর মেয়ে সুমিকেও দেখা যাচ্ছে।

সচিবের সাথে সৌজন্য স্বাক্ষাত করে দরপত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েও ইজারা চুড়ান্ত হবার বিষয়টিকে দূর্নীতির স্পষ্ট স্বীকারোক্তি হিসেবে দেখছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠানিক দূর্নীতি নিয়ে কাজ করে থাকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএসওসি’র ( ISOC) অপরাধ অনুসন্ধান বিভাগের  প্রধান এডাম গাডনার মনে করেন,  প্রাতিষ্ঠানিক অস্বচ্ছতা এবং অকার্যকরতার প্রকট দৃষ্টান্ত দুর্নীতি, জালিয়াতি ও লুটপাটের মানসে অবিবেচনাপ্রসূত তদবির, ঘুষ লেনদেন। বাংলাদেশ সরকারের বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সচিব মাঠ পর্যায়ে সরকারি কোন ক্রয় বা রাজস্ব অর্জিত হবে এমন  কোন বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তকে এড়িয়ে  সরাসরি  সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখেন কিনা ; সেটিই বড় বিষয়। টেন্ডারে সেকেন্ড লোয়েস্টকে কার্যাদেশ দেবার অনুরোধ জানিয়ে অধীনস্থদের ফোন করে ইনফ্লুয়েন্স করে থাকলে সেই সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার বিরুদ্ধেও দূর্নীতির অনুসন্ধান হওয়া উচিত। এমন অনৈতিক  অনুরোধের কারণে যদি রাষ্ট্রের রাজস্ব কমে, তবে যে কোন সাধারণ  নাগরিক ওই কর্মকর্তার ( সচিব) বিরুদ্ধে কোর্টে যাবার এখতিয়ার রাখেন। এমন কি ক্ষমতা সার্কেলের সমাপ্তি বা চাকরিকাল শেষ হবার পরও ওই ঘটনার তদন্ত বা অনুসন্ধান চলতে পারে। ‘

টান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক এম এ হালিম মনে করেন, সচিব পর্যায়ে অনিয়ম বা দূর্নীতির উদাহরণ প্রকাশ্য আসে কদাচিৎ, যদিও তারা এমন অনিয়ম করেন ঘন্টায় ঘন্টায়। দূর্নীতিকে প্রশ্রয়ও দেন, তবে সেটি প্রকাশ্য আনেন না। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি (ঠিকাদার) সচিবকে ব্যবহার করে সুবিধা পাচ্ছেন, তিনি তো স্বীকার করেই নিলেন। সচিব মহোদয় তাকে ইজারা পাবার বিষয়টি চুড়ান্ত করে দিয়েছেন। ‘

দাপ্তরিক ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট সুত্রমতে, কোন দরপত্র খোলার পর  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রভাবশালী কোন কর্মকর্তার  সিদ্ধান্ত প্রকাশ পাবার কারণে ওই দরপত্রের সার্বিক  প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে মুল্যায়ন কমিটির সদস্য, নির্বাহী প্রকৌশলী,  এসিস্ট্যান্ট চীপ ইন্জিনিয়ার (এসি) কিংবা সড়ক জনপথের প্রধান প্রকৌশলী সবাই নিরেপক্ষতা হারিয়ে  উর্ধতন কর্মকর্তার ( সচিব) আচরন বা ইচ্ছা  দ্বারা প্রভাবিত হবেন।

হঠাৎ উড়ে আসা শকুন 

সেই স্টাটাস বিশ্লেষণ করে বুঝা যায় প্রাক্তন  এমপির মেয়ে সুমিকে সাথে নিয়ে তদবির করতে গিয়ে তার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন ঠিকাদার মনসুর আলম পাপ্পী, বিষয়টি প্রকাশ্য দূর্নীতির গোঁমর ফাঁসের মতোই।

এদিকে, সপ্তম বার ইজারার দরপত্র ব্যতীত প্রতিবারই সর্বোচ্চ দরদাতা হন মাহফুজ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ উঠেছে ‘আমরিন এন্টারপ্রাইজ ‘ কে ফেরিঘাটের ইজারা দিতে ইতিপূর্বে সর্বোচ্চ দরদাতা হবার পর প্রতিবারই ‘ রি টেন্ডার ‘ করা হয়েছে। ভোগান্তির চুড়ান্ত পর্যায়ে গেল ২৭ জুলাই সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের  নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা (নির্বাহী প্রকৌশলী) ,  সেগুন প্রসাদ বড়ুয়া(সহকারী প্রকৌশলী)  আলী ছুট্টকে ( উপ সহকারী প্রকৌশলী) সুপ্রিম কোর্টের  আইনজীবী এ এসএম বাকী মারফত  আইনী নোটিশও দিয়েছে মাহফুজ এন্টারপ্রাইজ ৷

মাহফুজ এন্টারপ্রাইজের স্বর্তাধিকারী মাহফুজুর রহমান বলেন, কালুরঘাট ফেরির ইজারা নিয়ে শুরু থেকেই নাটকীয়তা চলছে। এখন পর্যন্ত সাত বার টেন্ডার করা হলেও পছন্দের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান  সর্বোচ্চ দরদাতা না হবার কারনে বার বার রিটেন্ডার করে জনসাধারণের ভোগান্তি বাড়ানোর পাশাপাশি রাস্ট্রের আদায়যোগ্য রাজস্ব কমিয়ে দিয়েছেন। সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা ও সহকারী প্রকৌশলী সেগুন প্রসাদ বড়ুয়া ফেরি থেকে আদায়কৃত টোল থেকে আমাকে দৈনিক বিশ হাজার অফিসকে দিয়ে দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সপ্তম বারের মতো টেন্ডারে যে প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ দরদতা নির্বাচিত হয়েছে ‘এ কে এন্টারপ্রাইজ ‘ সেই প্রতিষ্ঠানকে সিএস না দিতে নানামুখী ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন পিন্টু চাকমা । তাদের পে- অর্ডার কম আছে এমন অজুহাত তুলে পুনরায় টেন্ডার করার ছক আঁকছেন সড়ক জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ তিন কর্মকর্তা। অথচ রাষ্ট্রের স্বার্থের কথা বিবেচনা করলে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ঘাটের ইজারা দেয়া হতো। অতীতে সর্বোচ্চ দরদাতা হবার পরও আমাকে যেমন ইজারা  দেয়া হয়  নি ; এখন এ কে এন্টারপ্রাইজ’কেও  সিএস দেবে না তারা । ইতিমধ্যে তড়িঘড়ি করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা আমরিন এন্টারপ্রাইজকে সিএস দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কারণ এই প্রতিষ্ঠানের জন্যই মুলত অপেক্ষা করছিলেন সওজ সিন্ডিকেট। ‘

সড়ক ও জনপদ চট্টগ্রাম বিভাগের সুত্রমতে, কালুরঘাট ফেরির ইজারা প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে অন্তত ছয় মাস আগে। প্রথম তিন দফা টেন্ডারে কোন প্রতিষ্ঠান ফেরি ইজারা নিতে আগ্রহই দেখাই নি।

অংশগ্রহণ করা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহফুজ এন্টারপ্রাইজ পঞ্চম দফা টেন্ডারে দুই কোটি টাকা দর কোড করলেও দরপত্রে সেই কাগজ সরিয়ে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা দর বসিয়ে দেন পিন্টু চাকমা ও সেগুন প্রসাদ বড়ুয়া। সেই দর অনুযায়ী সিএস পাস করার প্রক্রিয়া সম্পন্নও করা হয়েছিলো। এরমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান একে এন্টারপ্রাইজ লিখিত অভিযোগ জমা দিলে ভেস্তে যায় পিন্টু চাকমার সেই পরিকল্পনা।

জানতে চাইলে মাহফুজ এন্টারপ্রাইজের স্বর্তাধিকারী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ তখন তারা বলেছিলেন কম মুল্যে ফেরিঘাটে ইজারা নিয়ে দিচ্ছে, আমিও আপত্তি করিনি। কিন্তু সর্বশেষ টেন্ডার খোলার পর এখন পর্যন্ত  কোন ধরনের মুল্যায়ন কার্যক্রম  সম্পন্ন না হলেও আমরিন এন্টারপ্রাইজ মিস্টি বিতরণ শুরু করেছে।  সচিব নাকি দিয়েই দিয়েছেন। যদি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে  কম মুল্যে এই ফেরিঘাট ইজারা দেয়া হয়, তবে প্রমাণ হবে কেন গত ছয়টি বার রিটেন্ডার করা হয়েছে ।   ‘

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখন পর্যন্ত সাতবার দরপত্র আহবান করা পরও ঠিকাদার নিয়োগ চুড়ান্ত করতে না পারার অজুহাতে  নিজস্ব জনবল দিয়ে ফেরি চালাতে গিয়ে লেজে-গোবরে অবস্থা সওজের। ফেরি চলাচলে বিশৃঙ্খলা ও জোয়ারের পানিতে অবর্ণনীয় কষ্ট পোহাচ্ছেন মানুষ।

নথি পর্যালেচনায় করে দেখা যায় ৩য় থেকে -৬ ষ্ঠ বার দরপত্র আহবান করা পর্যন্ত সর্বোচ্চ দরদাতা মাহফুজ এন্ড ব্রাদার্স। প্রতিষ্ঠানটি ৩য় দফা – ৮৫ কোটি, ৪ র্থ দফায় ১কোটি সাত লাখ, ৫ ম দফায় ১ কোটি সাত লাখ,৬ ষ্ঠ দফা আহবান করা টেন্ডারে -এক কোটি পঞ্চান্ন লাখ টাকা এবং সর্বশেষ সপ্তম বারের টেন্ডার আহবানে এক কোটি পঁচাত্তর লাখ টাকা দর প্রস্তাব করে।

অন্যদিকে সর্বশেষ টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান এ কে এন্টারপ্রাইজ ৩য় দফায় পয়ষট্টি লাখ টাকা, ষষ্ঠ দফায় এক কোটি আটারো লাখ টাকা এবং সর্বশেষ (সপ্তম বার)  ২ কোটি পঁচিশ লাখ টাকা দরপ্রস্তাব করেছে। তবে ৪ র্থ দফা ও পঞ্চম দফা টেন্ডারে অংশ নিতে দেয়া হয় নি  একে এন্টারপ্রাইজকে।

অন্যদিকে, আমরিন এন্টারপ্রাইজ – শুধুমাত্র সপ্তম বার দরপত্র  আহবানে উড়ে এসে জুড়ে বসেন। ভাগযোগ করে মিলেমিশে  নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টুচাকমার সাথে  ঘাট ইজারার ব্যবসা করতে রাজি মনসুর আলম পাপ্পী।২৪ শে আগস্ট টেন্ডার  ওপেন করা হলে প্রতিষ্ঠানটি ২,১৪,০০,০০০.০০ টাকা দর কোড করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হয়। কিন্তু, ভাগঝোকের খেলায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবেই সিএস পেতে যাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটি।

সওজ সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট সেতু এলাকায় চলাচলের জন্য তিনটি ফেরি ও পন্টুন স্থাপন করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)। ফেরি চলাচলের জন্য এ পর্যন্ত  সাতবার দরপত্র  আহব্বান করা হয়। গত বৃহস্পতিবার (২৪ শে আগস্ট)   সপ্তম দফা টেন্ডার দাখিল করা হয়। তিনটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান টেন্ডার ফরম দাখিল করে। সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হন একে এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রস্তাবিত সর্বোচ্চ দর দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা।

সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘ সপ্তম  দফায় ফেরি ইজারার টেন্ডার জমা নেয়া হয়। টেন্ডার ফরম মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তবে তা-ও দেয়া যাবে কিনা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী দুই  ঠিকাদার অভিযোগ দিয়েছে। সর্বোচ্চ দরদাতা একে এন্টারপ্রাইজের (২,২৫,০০,০০০/-) পে-অর্ডার কম আছে। তবে ইজারার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থকেই বড় করে দেখা হয়।  ’

সূত্র জানায়, ফেরি চলাচলের ইজারা পেতে বালু মহালের ইজারাদার  সিন্ডিকেটের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলে আসছিলো। মুলত কালুরঘাট সেতু এলাকায় বালুর মহাল ইজারা নেয়া আমরিন এন্টারপ্রাইজ যে কোন মুল্যে ইজারা নিতে চায় কালুরঘাট ফেরি। ইতিপূর্বে কালুরঘাট এলাকায়  রেলওয়ের মালিকানাধীন ‘মুহুরী ঘাট ‘ এভাবে একযুগ ধরে দখলে  রেখেছে চক্রটি। সুত্রমতে,  সম্প্রতি বালু রাখার কৌশল ব্যবহার করে দখল করে নিয়েছে রেলের আরও সাত একর জায়গা। সুত্রমতে, বড় অংকের ঘুষ নিশ্চিত হবার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম বার দরপত্র জমা দেবার পরপরই তাদের অনুকূলে সিএস পাস করার তোড়জোড় শুরু হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ,  আমরিন এন্টারপ্রাইজকে সামনে রেখে সড়ক ও জনপদ বিভাগের তিন কর্মকর্তাই চালাবেন কালুরঘাট সেতু। একইভাবে পর্দার আড়াল থেকে  চট্টগ্রামের শাহ আমানত সেতু, পোর্ট এক্সেস রোডের টোলপ্লাজা এবং সীতাকুণ্ডের ওজন স্কেল চালাচ্ছেন সড়ক ও জনপথের এই তিন কর্মকর্তা।

তৃতীয় বার থেকে ষষ্ঠ বার পর্যন্ত সর্বোচ্চ দর প্রস্তাবকারী প্রতিষ্ঠানের অনূকূলে সিএস না দেবার পেছনে কাজ অংশীদারত্বের প্রশ্নে সমঝোতা না হওয়া   । তবে সওজের একটি সুত্রমতে, ছয় মাসের জন্য নয় তিন বছরের জন্য কালুরঘাট ফেরি ঘাট ইজারা পেতে জোর তদবির চালান স্থানীয় বালু মহালের ইজারাদার মনসুর আলম পাপ্পী। ৬/৭ মাস পর সেতু সংস্কার সম্পন্ন হলে এই ঘাট ব্যবহার করে কর্ণফুলী নদী থেকে বালু গড়ে  তোলা হবে।

সপ্তম দফার দরপত্রে ২ কোটি চৌদ্দ  লাখ টাকা কোড করেও সর্বোচ্চ দরদাতা হতে না পারায় সরকারি সড়ক ও জনপথ বিভাগের সচিবের দ্বারস্থ হন। তার সাথে দেখা করে সেই ছবি ছড়িয়ে দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। নিজেই ঘোষণা দিয়ে বসেন, সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে তিন বছরের জন্য  কালুরঘাট ফেরির ইজারা পেয়েছে তার প্রতিষ্ঠান আমরিন এন্টারপ্রাইজ। অথচ ছয় মাস পরে ফেরি চলাচলই থাকবে৷

পাপ্পীর  ব্যবসায়ীক পার্টনার জানান, এই ফেরিঘাট আসলে ব্যবসায়ীক লাভের জন্য নয়, তাদের চলমান ব্যবসার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য হাতের মুঠোয় নিচ্ছে সিন্ডিকেটটি। আসলে পরিচালনা করবেন সড়ক ও জনপথের কর্মকর্তারাই৷ রাতের বেলায় ফেরি ঘাটের কিছু গোপন হিসেবে নিকেশ আছে, পাপ্পীর দৃস্টি সেখানে।

এদিকে,  সওজের কর্মকর্তাদের মতে  নিয়ম অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি ইজারার দরপত্রে অংশ নেবার সুযোগ নেই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা আমরিন এন্টারপ্রাইজের মালিক মনসুর আলম পাপ্পীর বিরুদ্ধে একটি মাদক পাচার মামলায় তিন বছরের কারাদন্ড দিয়েছিলো আদালত। এছাড়া চুরিসহ বেশ কিছু ফৌজদারি মামলা চলমান রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সে তথ্য জেনেই তাকে সহযোগিতা করেছে সওজ এর দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘ আমরিন এন্টারপ্রাইজ প্রথম অংশ নিয়েছে।  ফেরি ইজারার সপ্তম টেন্ডারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় সাজা থাকলে সেটি বিবেচনায় আনা হবে।  চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ঢাকায় দরপত্রের প্রতিবেদন ও সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।  যেহেতু সিদ্ধান্ত এখনও চুড়ান্ত হয় নি,  কেউ ফেরিঘাট ইজারা পেয়েছে এমন ঘোষণা দেয়া অনৈতিক। সচিব মহোদয়কে বিব্রত করার জন্য তার ছবি ফেসবুকে দেয়া  হয়েছে ‘।

জানা যায়, সর্বোচ্চ দরদাতা হবার পরও ফেরি ইজারা দেয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার অভিযোগ এনে সড়ক ও জনপদ বিভাগের মন্ত্রী ও সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন সর্বশেষ টেন্ডারে সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান এ কে এন্টারপ্রাইজের আবুল কালাম।

পর্যালোচনা করে দেখা যায় মনসুর আলম পাপ্পীর ফেসবুক ওয়ালে দেয়া ছবিতে সড়ক ও জনপদ বিভাগের সচিব আমানুল্লাহ নুরীকে ‘ভাইজান’সম্মোধন করে সেই ছবি ট্যাগও করেছেন। জানা যায়, মনসুর আলম পাপ্পী নিজেকে বাঁশখালী আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি পরিচয় দিয়ে থাকেন। মাদক পাচার, চুরি, পুলিশ পরিচয় দিয়ে ব্যবসায়ীকে হুমকি দেয়া, দেড় বছরের শিশুকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দেয়াসহ নানা অপরাধ ও বিতর্কিত কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন।

আলোচিত কালুরঘাট ফেরি ঘাটের ইজারার প্রক্রিয়ায় একটি বিতর্কিত চক্রের পক্ষে  অনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ চট্টগ্রামের এসি আতাউর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা, সহকারী প্রকৌশলী সেগুন প্রাসাদ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্টদের মতে চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপদ এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের  পোর্ট এক্সেস রোডের টোল আত্মসাত ছাড়া শাহ আমানত সেতু টোল ব্যবস্থাপনায় নজিরবিহীন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিভাগীয় পদ্ধতিতে টোল আদায়ের নামে তিন টোল প্লাজা থেকে শত কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ পোঁছেছে দূর্নীতি দমন কমিশনে।

দরপত্র মুল্যায়ন প্রক্রিয়া শেষ হবার আগেই অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে বৈঠক এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বৈঠকের ছবি দিয়ে ইজারা পাবার ঘোষণা দেয়া  কতোটা নৈতিক এবিষয়ে মন্তব্য জানতে সড়ক ও জনপদ বিভাগের সচিব আমানুল্লাহ নুরীকে বার বার মুঠো ফোনে কল দেয়া হলোও তিনি সাড়া দেন নি।