আবুল হোসেন শাহ চৌধুরী ‘ নাজিরহাট পরির্বতনের জ্যোতির্ময় প্রাণপুরুষ


ওয়াহিদ জামান 

প্রকৃতির নরম চাদরে পাশ্ববর্তী নদী হালদার ভাঙনের মতো কর্কশ ভালোবাসার মাঝেই বাধা উড়িয়ে নাজিরহাটের উন্নয়নে ছুটে চলা মহেশ্বর মানব ‘ আবুল হোসেন শাহ চৌধুরী। বাংলাদেশসহ নিম্ন আয়ের দেশের প্রান্তিক নাগরিকদের কাছে  শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেবার ব্যর্থতা যখন ‘শিক্ষাদারিদ্র্য’ বলে পরিচিতি পেয়েছে,  তখনই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেবার স্বপ্ন ছিলো ‘আবুল হোসন শাহ চৌধুরী’র চোখে মুখে।

পূর্বফরহাবাদে আবুল হোসেন শাহ চৌধুরী জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৯২০ সালে। পঞ্চাশের দশকেই তিনি অনুধাবন করেছিলেন ভিত্তি পর্যায়ের  দুর্বলতা শিশুদের পরবর্তী স্তরের শিক্ষার অর্জনকে ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত করে। তাই তো বয়স যখন ত্রিশের চৌকাঠ মাড়িয়েছে,  নিজ গ্রামের একপ্রান্তে ১৯৫১ সালে নাজিরহাট পূর্ব ফরহাদাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

আবুল হোসেন শাহ চৌধুরী কর্মজীবনে বাংলাদেশ রেলওয়েতে কর্মকর্তা ছিলেন, কিন্তু তার ধ্যান জ্ঞান ছিলো ফটিকছড়ির নাজিরহাটকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে মূর্খতার অন্ধকার থেকে বের করে আনা। নাজিরহাট এলাকার পঞ্চাশ  থেকে আশির দশকে গড়ে উঠা  প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের পেছনে ছিলো তাঁর অনবদ্য ভূমিকা। স্বার্থকেন্দ্রিক বেঁচে থাকার মধ্যে কোনো সুখ নেই ‘ এমন জীবনদর্শন হৃদয়ে ধারন করে আবুল হোসেন শাহ চৌধুরীর তার জীবনের ধাপে ধাপে প্রমাণ করেছেন- প্রকৃত সুখ রয়েছে সমাজের জন্য, দেশের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করে বাঁচার মধ্যে।একারণেই  নিজেকে ও নিজের পরিবারকে ঘিরে আত্মকেন্দ্রিকতার সংকীর্ণ কোন গণ্ডি গড়ে তুলেন নি তিনি।

এই ছোট লেখায় আবুল হোসেন শাহ চৌধুরীর সমাজকর্ম   বর্ণনা করা সম্ভব নয়৷ তার বড় ছেলে  মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি (১৯৭৯) ছিলেন। মজহারুল হক শাহ চৌধুরী ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হিসেবে ফটিকছড়ির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন  ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। মেজ ছেলে  মোজাম্মেল হক শাহ অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। আরেক সন্তান দীর্ঘদিন থেকে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিস এর পরিচালক হিসেবে ব্যবসায়ী কমিউনিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অপর দুই সন্তান মুজিবুল হক শাহ ব্যাংক কর্মকর্তা,মোকাম্মেল হক শাহ পেশায়  ব্যবসায়ী।

মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পিছিয়ে শিক্ষার  তুলিটানা চিত্র থেকে নাজিরহাটকে বের করে আনতে জীবনের পুরোটা সময় ব্যয় করেছেন তিনি। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের  বৈশ্বিক অস্তিত্বকে সম্মৃদ্ধ করতে দেশ ও সমাজ হিসেবে শিক্ষার প্রকৃতি ও সংস্থান নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা করেছিলেন আবুল হোসেন শাহ চৌধুরী। নাজিরহাট কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ভুমি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান ও কলেজের উন্নয়নে তার অবদান চাপা পড়েছে প্রচারবিমুখ মনোভাবের কারণে।

এরিয়াল ডুরান্ট নামের একজন বলেছিলেন, “শিক্ষা হলো সভ্যতার রূপায়ন। শিক্ষার মাধ্যমেই সভ্যতা বিকশিত হয়, মনুষ্যত্ব বৃদ্ধি পায়- সেই সত্য নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। শিক্ষার আলো ছড়াতে এবং সমাজে থেকে অন্ধকার ও কুসংস্কার দূর করতে তিনি নাজিরহাটের মতো পল্লীগাঁয়ে পিছিয়ে পড়া অবহেলিত নারীদের শিক্ষার জন্য ১৯৭৫  সালে নাজিরহাট  বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ১৯৮৬ সালে নাজিরহাট আদর্শ  উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দ্যেগ নেন বহুধারায় বিভক্ত,  সমান্তরাল মন মানসিকতার মানুষদের নিয়ে।

তার প্রতিটি কাজ, কথা, গতি, স্থিতি, আচরণ, এমনকি ভবিষ্যৎ ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে বলা যায় যতদিন  বেঁচে ছিলেন, বেঁচেছেন সম্মান নিয়ে ; মানুষের ভালোবাসা নিয়ে।তার জীবন দর্শন ছিলো, ৫০ বছর বয়স অতিক্রম   করা মানেই কবরের দূরত্ব কমে আসা ।

সরকারী চাকরিতে হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে নানামুখী উত্থান ও পতনের ভেতর দিয়ে জীবনের বিশাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন দেখেছেন সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে জীবনের ৭২ টি বসন্ত ঝরে গেছে ; তখনও তিনি নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর আঙ্গিনায় মায়ার টানে ভোর থেকে কাটিয়েছেন সন্ধ্যা। নাজিরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নাজিরহাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও পূর্ব ফরহাদাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন ; এসব প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন তিনি।

হালদা নদীর তীর ঘেঁষে ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নাজিরহাট কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয় । প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি।শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফটিকছড়ি হাটহাজারী এলাকার শিক্ষার্থীদের  উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিলো অসামান্য। ফতেয়াবাদ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ তৎকালিন ভিসি ডঃ আব্দুল করিম তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসাবে নাজিরহাট কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য হিসাবে মনোনীত  করেছিলেন।

সরকারী চাকরির সাপ্তাহিক ছুটি রোববার (তখন) বাড়ি আসলেই এলাকার সামাজিক সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বিচার -আচারে ন্যায় বিচারের জন্যই গ্রাম্যসালিশে তার ডাক পড়তো।নাজিরহাটের রাস্তাঘাট উন্নয়নেও আবুল হোসেন শাহ চৌধুরী অসামান্য অবদান রেখেছেন।  আশির দশকে  বাড়ির পাশে হালদা নদীর ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দল সফর আসে নাজিরহাটে। ডেনমার্কের এক নাগরিক বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি হিসাবে সেটি তদারকির দায়িত্বে ছিল। তাঁর সাথে ইংরেজীতে কথা বলার কোন লোক ছিল না পুরো এলাকায়। আবুল হোসেন শাহ সেই বিদেশির সাথে  কথা বলতেন ভাঙনের সমস্যা নিয়ে । পুরো ফটিকছড়িবাসীর স্বাস্থ্য সেবার নাজুক অবস্থা দুর করতে আবুল হোসেন শাহ চৌধুরীর প্রচেষ্টায় নাজিরহাটে প্রতিষ্ঠিত হয় ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।

১৯৯২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত নাজিরহাট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, পূর্ব ফরহাদাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নাজিরহাট বাজার মসজিদের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। আবুল হোসেন শাহ চৌধুরীর  চারিত্রিক বৈশিষ্ঠের মধ্যে যে গুনাবলি সবার নজর কেড়েছে তা হলো সততা, সময়ানুবর্তিতা, ন্যায়পরায়নতা ও দৃঢ়তা।

নীরব আত্মত্যাগ, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে অহমিকার ভিত্তিপ্রস্তর না বসিয়ে বানিয়েছেন সর্বজনীন। মারা যাওয়ার পর নাজিরহাটে অনুষ্ঠিত নাগরিক শোক সভায় আবুল হোসেন শাহ চৌধুরীর  পদধূলিমাখা কাঁচারাস্তা নামকরণ করা হয় ‘ আবুল হোসেন শাহ চৌধুরী সড়ক ‘।

এক কথায় আবুল হোসেন শাহ চৌধুরী ছিলেন এক ক্ষণজন্মা মানবিক ব্যক্তিত্ব, নির্লোভ ত্যাগী সমাজসেবক, নন্দিত মানবপ্রেমিক যিনি সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, কুপ্রথা, ক্ষতিকর রীতি-নীতির মুলোৎপাটন করে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নাজিরহাটে মানবিক পরিবর্তনের বৈচিত্র্য তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।