ভারতীয় নমনীয় ঋনের প্রকল্পে সাড়ে চার বছর
২৬০ কোটি টাকার এলইডি প্রকল্প, এবার মিলেমিশে লুটপাট

নাদিরা শিমু,নিয়াজ তুহিন  :::

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৬০ কোটি টাকার স্মার্ট এলইডি প্রকল্পের দরপত্রে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ধারাবাহিক অনিয়মের খবর গণমাধ্যমে শিরোনাম হয় বিভিন্ন সময়ে। গত বছরের আগস্ট মাসে ভারতীয় তিনটি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি প্রস্তাব মুল্যায়নে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পোঁছে ভারতীয় দুতাবাস পর্যন্ত। পরে এক বছরে সেই  কারিগরি প্রস্তাব মুল্যায়নের রেজুলেশন তৈরি করে পাঠাতে পারেন নি প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাবে ইন্ডিয়ান এলওসি’র ( লাইন অব ক্রেডিট)  কারিগরি প্রস্তাব মুল্যায়নের রেজুলেশন তৈরি করার বাধ্যবাধকতা নেই উল্লেখ করেন প্রকল্প পরিচালক  ঝুলন কুমার দাশ। চসিকের পক্ষ থেকে এমন জবাব পাবার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সিপিটিইউ ‘র কাছে ( সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিট) এই বিষয়ে মতামত চেয়ে পাঠান।

সিপিটিইউ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে মতামতের চিঠিতে উল্লেখ করেন পিপিআর ( পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস) অনুযায়ী আর্থিক প্রস্তাবনা খোলার আগে মুল্যায়ন শিটে মুল্যায়ন কমিটির সকল সদস্যর স্বাক্ষরসহ রেজুলেশন তৈরি করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৩ আগস্ট টেন্ডার অপেনিং কমিটির সভার বিষয়ে সরাসরি  চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। ওইদিন বিকাল তিনটায় আর্থিক প্রস্তাবনার খাম খোলার জন্য সভার দিনক্ষণ ঠিক করেন ঝুলন কুমার দাশ। নিয়ম অনুযায়ী মুল্যায়ন কমিটির আহবায়ক হিসেবে  চসিক মেয়র এমন অনুমোদন দিতেই পারেন না; যদিও তিনি এই প্রকল্পের হোপ হিসেবে রয়েছেন । দাপ্তরিক জটিলতার বিষয়টি বুঝতে পেরে শেষ মুহুর্তে সভার নাম পরিবর্তন করেন ‘ মুল্যায়ন কমিটির সভা ‘ ডাকেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ।

পরিবর্তিত সময়সূচি ( তিনটায় ছিলো)  সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে মুল্যায়ন কমিটির সভা চলাকালীন সময়ে পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী মাইনুদ্দিন জুয়েলের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের।

তিনি বলেন,  ‘ এটি টেন্ডার ওপেনিং কমিটির সভা নয়,  মুল্যায়ন কমিটির সভা। বহি:সদস্য হিসেবে তিনি সভায় অংশ নিয়েছেন। অভিযোগ উঠা ক্রুটিপুর্ণ মুল্যায়নের রেজুলেশনে তিনি স্বাক্ষর করবেন না। ‘

রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলা সেই কমিটির বৈঠকে রেজুলেশন প্রস্তুত করার বিষয়ে একমত হতে পারেন নি সদস্যরা।

বৈঠকে অংশ নেয়া কমিটির দুই সদস্য জানান, ‘ দরপত্র মুল্যায়নের  দুটি মুল্যায়ন শিট রয়েছে। একটি চসিকের, অন্যটি ইন্ডিয়ান এক্সিম ব্যাংকের। রেজুলেশন তৈরির ক্ষেত্রে কোন মুল্যায়ন নাম্বার শিট অনুসরণ করা হবে, সেটির সুরাহ করতে হবে মন্ত্রণালয়কে। ‘

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ তৌহিদুল আলম বলেন,  ‘ এই প্রকল্পের দরপত্র আহবানের পর ভারতীয় তিনটি প্রতিষ্ঠানের মুল্যায়নের নাম্বার নিয়ে অভিযোগ উঠে। তবে প্রকল্পের দরপত্র নিয়ে  জটিলতা কাটাতে কিছু  ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। ‘

এদিকে , মুল্যায়ন পর্ব শেষ না করেই গতকাল মঙ্গলবার গোপনে ওপেন করা হয়েছে আর্থিক প্রস্তাব। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দুই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা। তবে তারা জানান, আগামী দুই দিনের মধ্যেই কারিগরি প্রস্তাব মুল্যায়নের রেজুলশন তৈরি করা হবে।

সুত্রমতে, আর্থিক প্রস্তাবের খাম খোলার পর সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চুড়ান্ত করা হয়েছে  এনার্জি ইফিসিয়নসি লিমিটেডকে। ২য় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে রয়েছেন শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেড। কারিগরি প্রস্তাবের মার্কিং এবং আর্থিক প্রস্তাব মিলিয়ে শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডকে চসিকের এই আলোচিত ২৬০ কোটি টাকার এলইডি প্রকল্পের কাজ দেয়ার বিষয়টি অনেকটাই চুড়ান্ত। অথচ শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেড ( এলসপিএল) ভারতের বিহার রাজ্য সরকারের কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। রাজগিড় স্টেডিয়ামের কাজ সম্পন্ন করতে না পাবার কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে রাজ্য সরকার।

চসিকের নথি অনুযায়ী এই প্রকল্প ভারতের তিন প্রতিষ্ঠান কারিগরি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেড ( এসপিএল),  এনার্জি ইফিশিয়েসি লিমিটেড  ( ইএসএল), সিগনেফাই ইনোভেশন ইন্ডিয়া লিমিটেড ( ফিলিপস)। তিনটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় উপ ঠিকাদার হিসেবে শুরুতে মনোনয়ন জমা পড়ে এইচটিএমএস লিমিটেড, ট্রেড ম্যাজিট্রিড লিমিটেড, প্নটোস্টার লিমিটেড। কিন্তু এইচটিএমএস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আফতাব আহমেদ নানা জালিয়াতি ও দূর্নীতির কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কালো তালিকাভুক্ত। ট্রেড ম্যাজিট্রেডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মাহবুব হোসেন আবার এইচটিএমএস লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ৫৪ কোটি টাকার এলইডি প্রকল্প কাজ করছেন। দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ পরিকল্পনায় ২৬০ কোটি টাকার এলইডি প্রকল্পের কাজ হাতিয়ে নিয়ে  এমন লুটপাটের  ছক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিব্রত হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে গেল একবছরেও মুল্যায়ন কমিটির দুই বহিসদস্যের আপত্তির কারণে প্রকল্পটির দরপত্র ( কারিগরি প্রস্তাব)  মুল্যায়ন চুড়ান্ত করতে পারে নি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।

নথি অনুযায়ী যখন (২০২২ সালের আগস্ট) শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডের প্রস্তাবকে ৯৭ নাম্বার দিয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ এগিয়ে দিচ্ছিলেন তখনও শাপুর্জির গলায় ঝুলছে বিহার রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞা ( কালোতালিকাভুক্ত) এছাড়া ভারত সরকারের কর ফাঁকির মামলাও প্রতিষ্ঠানটির কাঁধে।

২০২২ সালের সেই ক্রুটিপুর্ণ মুল্যায়নের নম্বর ফর্দ অনুযায়ী  নিম্মমানের চায়না বাতি প্রস্তাব করা ( ওসরাম) শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডকে সর্বোচ্চ নাম্বার দিয়ে পছন্দের শীর্ষ রেখেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম, সাবেক প্রধান নির্বাহী শহিদুল আলম এবং প্রকল্প পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ। তবে দুই বহি:সদস্য সিগনেফাই ইনোভেশন  ইন্ডিয়া লিমিটেড ( ফিলিপসকে ৯৫+ নাম্বার দিয়ে  পছন্দের শীর্ষ রাখেন। আর আশি শতাংশ মার্কস দিয়ে এসপিসিএল এবং সিগনেফাই ইনোভেশন ইন্ডিয়াকে কৌশলী অবস্থানে ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) সূত্রে জানা গেছে, পুরো চট্টগ্রাম নগরকে আলোকিত করতে এলইডি প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয় ২০১৯ সালে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুন মাসে শেষ করার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে চারবার। সর্বশেষ ২০২২ সালের মার্চে দরপত্র আহ্বান করলেও, দরপত্রের ( এলটিএম) শর্ত এবং ডিপিপিতে বিভিন্ন ত্রুটি পাওয়া যায় একারণে এলজিআরডির বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানী গত বছরের  ২৮ মার্চ এই দরপত্রের নানা অসংগতির কথা তুলে ধরে পুনঃ দরপত্রের আহ্বানের পরামর্শ দেন।এই প্রকল্পে ঝুলন দাশের বিরুদ্ধে সরকারি ক্রয়বিধি অমান্য করা এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত শর্ত পরিবর্তনের অভিযোগ উঠে। ওই প্রকল্পটিও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে পুনঃদরপত্র দেওয়ার সুপারিশ করেন বিশেষজ্ঞ কমিটি। সেই সঙ্গে ঝুলন কুমার দাশকেও প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিলো। জাইকা প্রকল্প সংক্রান্ত চসিকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী (আইইসি ৬০০৬০-১) ক্যাবলের ইনসুলেশন রেসিসটেন্স থাকতে হবে ২ গিগাওম বা ২০০০ কিলোওম; কিন্তু চসিকের এলইডি বাতিতে যে ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে তার ইনসুলেশন রেসিসটেন্স পাওয়া গেছে তাম্র ১০০.৬ কিলোওম, যা আন্তর্জাতিক মানের মাত্র ২০ ভাগের এক ভাগ। প্রকল্পটির প্রকল্প পরিচালকও প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। এইচটিএমএস লিমিটেড অনিয়মে ভরা সেই প্রকল্পের মুল ঠিকাদার। আর ( স্মার্ট এলইডি প্রকল্পে ইএসএল এর প্রস্তাবিত উপ ঠিকাদার)  প্রকৌশলী মাহবুব হোসেন ওই ক্রুটিপুর্ণ প্রকল্পের উপ ঠিকাদার।

দরপত্রের শর্ত পরিবর্তন, ক্রুটিপূর্ন মুল্যায়ন, মানহীন লাইটের ব্র্যান্ডকে পছন্দের শীর্ষে রাখা, দরপত্রের নথি গোপন, পিপিআর বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও হাল ছাড়েন নি প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। অনিয়মের অভিযোগে গণমাধ্যমে শিরোনাম হলেও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন না করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রকে  উল্টো ঝুলনের দূর্নীতিকে তোষণ করতে দেখা যায় এলইডি প্রকল্পের দরপত্র জালিয়াতির ছকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কঠোর গোপনীয়তায় ভারতীয়  তিনটি প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ সমঝোতায় আর্থিক প্রস্তাব খোলা হয়েছে গত মঙ্গলবার (২২ শে আগস্ট) ।

কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাবনা বিবেচনায় নিয়ে এই প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগের কথা বলা হলোও সংস্থাটি এক শীর্ষ কর্মকর্তা ( মুল্যায়ন কমিটির সদস্য) জানান, ‘ যতই অনিয়মের অভিযোগ উঠুক কাজটি শেষ পর্যন্ত পাচ্ছেন অভিযোগ উঠা কালোতালিকার সেই আলোচিত প্রতিষ্ঠান শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেড। গোপন সমঝোতা অনুযায়ী  প্রকল্পটিতে সিগনেফাই ইনোভেশন ইন্ডিয়া কিছু সরবরাহের কাজ পাবেন ( সাব কন্ট্রাক্ট)।’

একাধিক সুত্র এমন সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। দুই বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে  মিলেমিশে স্মার্ট এলইডি প্রকল্পের কাজ করাতে চান মেয়র। এই কারণে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হচ্ছে শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডকে। একই সাথে এসপিসিএল’র নামে চলা প্রকল্প সাপ্লায়ার হিসেবে কাজ করবেন সিগনেফাই ইনোভেশন ইন্ডিয়া লিমিটেড।

অনিয়মের ঢালাও অভিযোগ যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে,  একই সাথে ভারতের বিহার রাজ্যে কালোতালিকাভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানকে কেনই বা প্রকল্পটির কাজ পাইয়ে দেয়া হচ্ছে – এমন প্রশ্নের উত্তরে মুখ খুলতে নারাজ প্রকল্প পরিচালক  ঝুলন কুমার দাশ। শাপুর্জি পালনজি’কে কাজ পাইয়ে দেবার  খেলায় ভারতের এক্সিম ব্যাংক ঢাকা এবং দিল্লির তিন কর্মকর্তার জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে। প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ এই প্রকল্পের কাজ দেবার ক্ষেত্রে  এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়ার অজুহাতে খোলামাঠে দূর্নীতি ও অনিয়মের চুড়ান্ত রেকর্ড করেছেন।

আমাদের ভারত প্রতিনিধির দেয়া তথ্য অনুযায়ী,  চসিকের পছন্দের প্রতিষ্ঠান ভারতের ‘ শাপোর্জি পালনজি লিমিটেড’ বিহার রাজ্যে রাজগীড় স্টেডিয়ামের কাজ সম্পন্ন করতে না পারার কারণে রাজ্য সরকারের নিষিদ্ধ তালিকায় পড়ে । টাইমস অব ইন্ডিয়ায় এই খবরটি ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া, ভারতের ব্যাংলোরে তিন লক্ষ এইইডি লাইট স্থাপনের কাজ করতে না পারার কারণে এসপিসিএল’এর কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে ২০২১ সালের ৩ রা ডিসেম্বর।

২০০৮ সালের পিপিআর বিধিমালা অনুযায়ী কালোতালিকাভুক্ত কোন প্রতিষ্ঠান টেন্ডার মুল্যায়ন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হবার কথা নয়। এছাড়া, এই এলইডি প্রকল্পের আন্তর্জাতিক টেন্ডার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়,  কালোতালিকাভুক্ত কোন প্রতিষ্ঠান অযোগ্য ঘোষিত হবার কথা। কিন্তু হয়েছে উল্টো। বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠানকেই ( ৯৭ মার্কস দেন) পছন্দের শীর্ষে রেখেছেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ।

পিপিআর বিশেষজ্ঞ ড. গোলাম ইয়াজদানীর মতে, একনেক অনুমোদিত ডিপিপি পরিবর্তনের মারাত্নক অভিযোগ ছিলো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এই প্রকল্পে দরপত্র আহবানে। দরপত্রের শর্ত ও ডিপিপিতে কাঁটাছেড়া করার বিষয়টিও স্পষ্ট। ‘

দরপত্রের শুরু থেকেই নিজের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতেই একনেকে অনুমোদিত ব্র্যান্ড বাদ দিয়ে অখ্যাত ব্র্যান্ড যুক্ত করে দেন পিডি ঝুলন দাশ। প্রকল্পটির কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক যেকোনো দরপত্রের শতভাগ কাজ সমাপ্তের অভিজ্ঞতা (FAC) সনদপত্র থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা থাকলেও,  প্রকল্প পরিচালকের পছন্দের প্রতিষ্ঠান শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেড ও এইচটিএমএস লিমিটেডকে ( উপ ঠিকাদার)  সুবিধা দিতে  শর্তে কাটাছেঁড়া করে দরপত্রে বলা হয়েছে, ৭৫ শতাংশ কাজ সমাপ্তের অভিজ্ঞতা থাকলেই চলবে। কারন দরপত্র আহবানের সময়  এইচটিএমএস জাইকা প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করেছিলো। কিন্তু সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় দেশের অধিকাংশ  গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার কারনে।

চসিকের সুত্রমতে,  বিপত্তির মুখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কালোতালিকাভুক্ত আফতাব আহমেদের ‘এইচটিএমএস লিমিটেড’ বাদ দিয়ে গোপনে এনার্জি প্যাক নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রে সংযুক্ত করা হয়। যদিও এনার্জিপ্যাক স্মার্ট এলইডি লাইট স্থাপনের কোন প্রকল্পের কাজ কখনোই করেনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এনার্জি প্যাকে কর্মরত তিনজন কর্মকর্তা। দরপত্রে অংশ নেয়া ভারতের শাপোর্জি পালনজি লিমিটেড কিভাবে এনার্জিপ্যাককে স্থানীয় ঠিকাদার হিসেবে অথোরাইজড লেটার দিয়েছে সেই প্রশ্নও সামনে আসে। ম্যানুয়াল টেন্ডার হবার কারণে নথি পরিবর্তনের মাধ্যমে  জালিয়াতির বিরল নজির স্থাপন করেছেন প্রকল্প পরিচালক  প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ।

তবে, শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডের অনিয়মে জড়ানোর বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের  সুত্রমতে,  ২০১৭ সালে কোন ধরনের দরপত্র ছাড়াই শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডের সাথে ভোলায় ২০০ মেগাওয়াটের আইপিপি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করেছিলো পিডিবি। এমন কান্ডে সমালোচনায় জড়ান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী।

জানতে চাইলে সুজন ( সুশাসনের জন্য নাগরিক)  চট্টগ্রামের সম্পাদক এডভোকেট আকতার উল কবির বলেন, ‘ এতোসব অনিয়মের অভিযোগ উঠার পরও এলইডি বাতি প্রকল্পের রি টেন্ডার না করে শেষ পর্যন্ত  অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেবার পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হচ্ছে। লুটপাটের নতুন নজির স্থাপন করলো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। চট্টগ্রামের নাগরিকদের সেবাদানে পিছিয়ে পড়া চসিককে  ‘ নির্লজ্জ সংস্থা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত।  ‘

সিগনেফাই ইনোভেশন ইন্ডিয়ার অবস্থান 

বিশ্ববিখ্যাত বাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফিলিপস এই প্রকল্পের দরপত্র মুল্যায়নে অনিয়মের অভিযোগ তুললেও প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের  জেনারেল ম্যানেজার (বিপনন) কামরুল ইসলাম ও  চসিকের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের লুটপাট পরিকল্পনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ হাতে এসেছে । প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের বিদ্যুৎ উপ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের সাথে  ঘুষ লেনদেনের চেকের বিষয়ে কামরুল ইসলামের  জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোন কেটে দিয়েছেন বারবার।

তবে প্রতিবেদকের হাতে আসা ২১ টি অডিও কথোপকথন  ও ভিডিও ফুটেজ, ঘুষ বাণিজ্যের চেকের ফটোকপি বিশ্লেষণ করে অনিয়ম ও দূর্নীতিতে সিগনেফাই ইনোভেশন ইন্ডিয়া লিমিটেডের বিপনন কর্মকর্তা কামরুল ইসলামের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।

সুত্রমতে, এই প্রকল্প অংশ নেয়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার প্রকৌশলী মাহবুব হোসেন ( ট্রেড ম্যাজিট্রিড)  চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম, প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশের সাথে লুটপাটের চুড়ুইবাতিতে যুক্ত হয়েছেন কামরুল ইসলাম ( ফিলিপস) , পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী মাইনুদ্দিন জুয়েল, pwd এর নির্বাহী প্রকৌশলী। অনিয়মকে প্রতিষ্ঠিত করতে  প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিলো  স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক উপ সচিব, ইন্ডিয়ান এক্সিম ব্যাংক ঢাকার তিন কর্মকর্তার। মিলেমিশে  ২৬০ কোটি টাকার এই এলইডি বাতি প্রকল্পের দূর্নীতির কুশীলবদের মুখোশ উম্মোচন সময়ের দাবি।

ভারতেও বিতর্কিত শাপুরজি 

ভারতের পাটনায় রাজস্ব পুনরুদ্ধার মামলায় আলোচিত হন শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেড। পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) এর অধীনে বকেয়া ট্যাক্সের পরিমাণ পরিশোধে দেশটির কোর্ট নির্দেশ দেয় শাপুরজি পাহলানজি লিমিটেডকে।  ফলে প্রতিষ্ঠানটি বিহার পণ্য ও পরিষেবা কর আইনের (বিজিএসটি আইন) ধারা ১১২-এর অধীনে আপিল দায়ের বাধ্য হয়।

সাম্প্রতিক একটি রায়ে, ভারতের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি চক্রধারী শরণ সিং এবং বিচারপতি মধুরেশ প্রসাদের সমন্বয়ে গঠিত পাটনা হাইকোর্টের বেঞ্চ জিএসটি আপিল ট্রাইব্যুনালের অনুপস্থিতিতে ব্যবসায়িক জায়েন্ট শাপুরজি পালোনজিকে স্বস্তি দেয়  অর্থ পুনরুদ্ধার আদেশটি স্থগিত করে।

তবে এই বিষয়ে  ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং আদেশ কার্যকর করতে  রাষ্ট্রপতি বা রাজ্য সভাপতি পদ গ্রহণ করার  আদেশ পাস করা হচ্ছে। উত্তরদাতা-কর্তৃপক্ষ (এসপিএল)  ট্রাইব্যুনালটি অ-সংবিধানিক উল্লেখ করে  ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২৬ অনুসারে রিট পিটিশনটি দাখিল করেছিলেন। ২০২২ সালের  ৭ সেপ্টেম্বর দেওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের নোটিশ প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন  করেছিলেন।

GST APL-(০৪)  ফর্মে জারি করা চাহিদার সারাংশ এবং GST DRC-( ০৭)ফর্মে জারি করা আদেশের সারাংশ অনুযায়ী বকেয়া সম্পুর্ন  রাজস্ব পরিশোধ ছাড়া কোন প্রতিকার নেই।

তবে এই কার্যধারায় করের অংককে প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে ভারসাম্যের ২০% ইতিমধ্যেই জমা করা করেছে শাপুরজি পাহলানজি । ফলে বিহার পণ্য ও পরিষেবা কর আইনের ধারা ১১২ ধারায় আবেদনকারীকে আপিল ট্রাইব্যুনালের (ট্রাইব্যুনাল) সামনে প্রতিদ্বন্দ্বিত আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি দেয়।  তা সত্ত্বেও, GSTAT-এর অ-সংবিধানের কারণে আবেদনকারী BGST আইনের অধীনে একটি বিধিবদ্ধ প্রতিকার অস্বীকার করে।

ভারতের BGST আইনের ধারা ১১২ আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করার অনুমতি দেয়। ধারা ১১২(৯) অনুযায়ী  যখন আপীলকারী উপ-ধারা (৮) এ উল্লিখিত পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন, তখন আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত  অবশিষ্ট অর্থের জন্য পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপগুলি স্থগিত বলে নির্দেশ দেয় বেঞ্চ।

উল্লেখ, ভারতীয় আইনে আবেদনকারীকে (এসপিসিএল) উপধারা(৮) দ্বারা উদ্দেশ্য অনুযায়ী তহবিল জমা করার পরে B.G.S.T আইনের ধারা ১১২(৮) এবং (৯) অনুসারে অবশিষ্ট করের পরিমাণ সংগ্রহের স্থগিতাদেশ থেকে উপকৃত হওয়া থেকেও বিরত রাখা হয়েছে ধারা ১১২ মতে।